Site icon Parthokko.com.bd | পার্থক্য | Difference Between

জিপিএ ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য

জিপিএ ও বাস্তবতা

আজকের অভিভাবকরাও একসময় শিশু-কিশোর ছিলেন। তাঁরা কি রেসের ঘোড়ার মতো সব সময় বিজয়ী হওয়ার জন্য ছুটেছেন? অবশ্যই না। তখন পড়ালেখা ছিল জীবনের অংশ। কিন্তু এখন জীবন মানেই পড়ালেখা আর ভালো ফল! আসলে উচ্চতর লেখাপড়া, পরীক্ষায় জিপিএ পাওয়া, মেধাবীর স্বীকৃতি পাওয়া ইত্যাদি বিষয় যে জীবনে খুব একটা পার্থক্য সৃষ্টি করে না; প্রতিনিয়ত চারপাশে তেমনটা দেখার পরও আমরা শিক্ষা নিতে চাই না। সন্তানদের শুধু পড়ালেখা করতে বলা, কোচিং-প্রাইভেটে দৌড়ঝাঁপ করানো, নানা সিস্টেমে (যেমন ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সংগ্রহ) সন্তানদের স্বর্ণের গ্রেড ধরাতে আমরা কতই না উদগ্রীব! কিন্তু তাতে কাজের কাজ ঠিক কতটা হচ্ছে, তলিয়ে দেখছি না।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ অভিভাবকের প্রত্যাশা থাকে দুটি। প্রথমত, পড়ালেখা শেষে তারা যেন ‘ভালো’ কোনো পেশায় যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভালো পেশার সংজ্ঞায় আর্থিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক স্বীকৃতিকে মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তারা যেন ভালো ‘মানুষ’ হয়। সেটা হলে সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজেদের জীবনের শেষ দিনগুলো স্বস্তি ও শান্তিতে কাটবে বলে তাঁরা প্রত্যাশা করেন। অর্থাৎ পড়ালেখার মাধ্যমে সন্তানকে দক্ষতা ও মানবিকতার সমন্বয়ে গড়া ‘আদর্শ’ একজন মানুষ হিসেবে দেখতে চান। এ প্রত্যাশা সঠিক হলে অভিভাবকরা আসলে কি তা অর্জনে তৎপর রয়েছেন? ক্লাস ওয়ানের এক শিশু গণিতে ৬০ পেল নাকি ৯০, তা কি সত্যিই কোনো অর্থ বহন করে? তার পরও আমরা রেজাল্টের জন্য মরিয়া হই কেন? যেনতেন উপায়ে অর্জিত নম্বর কি সত্যিই তার ভাগ্য বদলে দেবে?

আমরা এখনও সেকেলে মুখস্থ বিদ্যা ও ফলনির্ভর শিক্ষা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু বিশ্ব যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, তাতে এরই মধ্যে সেগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আগামীতে কেউ আপনার সন্তানের জিপিএ, গ্রেড, ডিগ্রি, পজিশন জানতে চাইবে না। তাদের সরাসরি প্রশ্ন হবে- সে কী কী কাজ জানে? বাস্তব সমস্যা সমাধানে তার কেমন দক্ষতা রয়েছে? কারণ অনেক ভালো ফল কিন্তু ‘চিন্তা’ করতে পারে না; সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান করতে পারে না; টিম মেম্বার গতির সঙ্গে তাল মেলাতে অক্ষম কর্মী দিয়ে তারা কী করবে?

আরেকটা সংকট খুব প্রবল হচ্ছে। সেটা হলো, অভিভাবকদের অধিকাংশই সন্তানদের বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে শুধু নম্বর বা জিপিএ অর্জনে নিয়োজিত করছেন। তাদের অর্জিত ফল দিয়ে নিজেদের মান-মর্যাদা বাড়াতে চান! কিন্তু তাদের মানবীয় গুণাবলির বিকাশে থাকছেন চরমভাবে উদাসীন। এ ক্ষেত্রে আমরা দুটি বিষয় খেয়ালই করছি না। প্রথমত, সন্তানরা বয়সে যত বড় হবে, তারা আপনার থেকে তত দূরে সরে যাবে। তার নিজস্ব গণ্ডি হবে। নিত্যনতুন মানুষ ও পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মিশবে। ক্রমেই তার জীবনে জটিলতা বাড়বে। সেগুলোর অধিকাংশই ঘটবে আপনার অগোচরে। ফলে সেগুলোর সমাধান করা তাকেই শিখতে হবে। আর সেই দক্ষতা হঠাৎ অর্জন করা যায় না। ধীরে ধীরে চর্চার মাধ্যমে সেগুলো অর্জন করতে হয়। কিন্তু আমরা সেই চর্চায় তাদের নিয়োজিত করছি না; শুধু পড়তে বলছি।

ইদানীং অনেক মা-বাবা বুঝতে পারেন না- সন্তানকে সবকিছু দেওয়ার পরও তারা কেন মনমরা হয়ে থাকে? তারুণ্যের উদ্দীপনা নেই; কারও সঙ্গে খেলে না; ঠিকমতো খায় না; ভালো করে কথাও বলে না! কারণ অভিভাবকরাই নিজের অজান্তে তার শিকড়গুলো কেটে ফেলেছেন। এখন ওপরে পানি ঢাললেও তা সজীব ও সতেজ দেখায় না। খুব নির্মম শোনালেও এটা বাস্তবতা। বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হতাশ ও বিষণ্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের কষ্টগুলো শেয়ার করার মতো লোক খুঁজে পাচ্ছে না। তাই আপনি যদি সত্যিই সন্তানের কল্যাণ চান, তবে শুধু নিজে বন্ধুর মতো হতে চেষ্টা না করে আরও কিছু মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিন।

Exit mobile version