নিয়ন্ত্রণবাদ (Controllism) :
যে মতবাদ অনুসারে, মানুষের ইচ্ছা বা কর্মের কোনো স্বাধীনতা নেই এবং প্রতিটি কর্মই কোনো না কোনো কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তাকে নিয়ন্ত্রণবাদ বলে। নিয়ন্ত্রণ বাদ অনুসারে জগতের সব ঘটনায় নিয়ন্ত্রিত। এখানে নিয়ন্ত্রণ কথাটির অর্থ হল কারণ থেকে উৎপন্ন অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ বলতে বোঝায় সার্বিক কারণওতাবাদ। নিয়ন্ত্রণবাদ ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কীয় মতবাদ। এই মতবাদ অনুসারে, মানুষের ইচ্ছার কোনো স্বাধীনতা নেই।
তবে অদৃষ্টবাদের সাথে এ মতবাদকে এক করে দেখা ঠিক নয়। কারণ নিয়ন্ত্রণবাদ সঠিক কার্যকারণ সম্পর্কীয় মতবাদ। যার মূল কথা হলো অন্যান্য ঘটনার মতো আমাদের ক্রিয়াকলাপও পূর্ববর্তী কতকগুলো কারণের অধীন। এই পূর্ববর্তী কারণ মানসিক না প্রাকৃতিক না অন্য কোন ধরনের এ মতবাদের কোন ইঙ্গিত না দিয়ে আমাদের শুধু এ টুকুই বলে যে কারণ যে কোনো ধরনের হতে পারে।
অনিয়ন্ত্রণবাদ (Non-Controllism) :
অনিয়ন্ত্রণবাদ নিয়ন্ত্রণবাদের বিপরীত মতবাদ। যে মতবাদ অনুসারে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে এবং তার কর্ম নির্বাচনে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তাকে অনিয়ন্ত্রণবাদ বলে। এ মতবাদ অনুসারে, মানুষের ইচ্ছাশক্তি মুক্ত। মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক পরিবেশে সে যখন বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন সে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তার জন্য উপযোগী পরিস্থিতি বেছে নেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও অন্যান্য ঘটনার দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত হয়, কিন্ত তাই বলে মানুষের কোনো ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই, তা নয়।
অদৃষ্টবাদের অসারতা অনিয়ন্ত্রণবাদের মানুষ স্বাধীন মনন ক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করে। আবার দেখা যায় আমরা যখন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি তখন অনুভব করি সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে আমরা স্বাধীন। আর যখন বুঝতে পারি যে একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে তখন সেটার পরিবর্তনও আমরা করি।
নিয়ন্ত্রণবাদ ও অনিয়ন্ত্রণবাদের মধ্যে পার্থক্যঃ
নীতিবিদ্যা একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। নীতিবিদ্যা মানুষের ন্যায়-অন্যায়, ভাল মন্দ, নিয়ে আলোচনা করে। নিয়ন্ত্রণবাদ ও অনিয়ন্ত্রণবাদের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-
১। নিয়ন্ত্রণবাদের মূল কথা হলো, “ যা ঘটে তা নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রণবাদের মূল কথা হলো“ যা ঘটে তার সবই অনিয়ন্ত্রিত।
২। নিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই। অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে মানুষের সম্পূর্ণ ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে।
৩। নিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে আমাদের কামনা বাসনা স্বাদ, ইচ্ছা সবই বাইরের শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে আমাদের কামনা, বাসনা, ইচ্ছা, সংকল্প সবই মন দ্বারা স্বাধীন ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
৪। নিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে জগতের প্রত্যেক ঘটনার কারণ রয়েছে। কারণ ছাড়া কোনো কিছু ঘটে না। সুতরাং মানবিক ঘটনা হিসাবে ইচ্ছারও একটি কারণ থাকতে পারে। অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রণবাদীরা বলেন, প্রত্যেক ঘটনার পিছনের এক বা একাধিক কারণ থাকলেও এর অর্থ এই নয় যে মানসিক ঘটনাবলি কোনো কারণের দ্বারা সংঘটিত হয়।
৫। নিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে মন হলো মস্তিষ্কের একটি উপজাত ব্যাপার, তাই মনের কোনো নিজস্ব শক্তি নেই। সুতরাং মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকতে পারে না।
৬। নিয়ন্ত্রণবাদের মতে, যে কোনো কাজের পিছনেই একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রণবাদীদের মতে, কাজের পিছনে কোনো উদ্দেশ্য নেই।
৭। নিয়ন্ত্রণবাদ মেনে নিলে কর্মের জন্য মানুষকে দায়ী করা চলে না। অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রণবাদ মেনে নিলে কর্মের জন্য মানুষকে তার কর্মের জন্য দায়ী করা যায়।
৮। নিয়ন্ত্রণবাদীদের মতে ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই যদি জগতের সবকিছু পরিচালিত হয়। অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রণবাদীরা বলেন, ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই যদি আমরা চালিত হই তাহলে মানুষের কৃতকর্মের ফলাফলের জন্য মানুষকে দায়ী করা হবে কেন।