অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য

অপরাধ (Crime):
অপরাধের সংজ্ঞায় ই. ইযঁংযধহ (১৯৮৯ : ৫১) বলেছেন, অপরাধ বলতে বুঝায় গোষ্ঠীগত রীতিনীতির পরিপন্থী কোনো আচার-আচরণ। এসব আচরণ প্রতিষ্ঠিত কোনো গোষ্ঠী কিংবা তাদের আইন কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য কষ্টদায়ক সমাজবিরোধী আচরণ। (Crime refers to any behaviour contrary to the groups of moral codes for which there are formalized group sanctions whether they are laws or not. It is anti-social behaviour harmful to individuals or groups). সাধারণত অপরাধের দু’টি দিক রয়েছে। (ক) সামাজিক- অর্থাৎ সমাজের বিধিবহির্ভূত কাজকে অপরাধ বলা হয় এবং (খ) আইনগত- এটি রাষ্ট্রীয় আইনের পরিপন্থী আচরণ। অর্থাৎ রাষ্ট্র বা আইন কর্তৃক অননুমোদিত কাজ হচ্ছে অপরাধ।

গিলিন ও গিলিন তাঁদের ‘Cultural Sociology’ গ্রন্থে বলেছেন, জৈবিক দিক থেকে অপরাধের ধারণা ব্যক্তির অন্তর্নিহিত ক্ষমতার মধ্যে নিহিত। সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিকশিত ব্যক্তিত্বের পার্থক্য অপরাধের সূচনা করে। তাঁদের মতে, সমাজের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকদের বিশ্বাস মতে যারা ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত, সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞানুযায়ী তারাই অপরাধী বা কিশোর অপরাধী বলে বিবেচিত।

বিচ্যুত (Deviant):
সাধারণ অর্থে মানুষের যেসব আচরণ সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী, সমাজে অসংগতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাকে বিচ্যুত আচরণ বলে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিচ্যুত আচরণকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন সমাজবিজ্ঞানী J. D. Ross (১৯৭২ : ২৯৮) বলেছেন, বিচ্যুত আচরণ হচ্ছে ঐ সব আচরণ যেগুলো সামাজিক প্রত্যাশাকে নিশ্চিত করতে পারে না। (Deviant behaviour is that behaviour which does not confirm to social expectation).

B. Bhushan তাঁর ‘Dictionary of Sociology (১৯৮৯ : ৭২) গ্রন্থে বলেছেন, বিচ্যুতি প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয় এমন আচরণ বুঝাতে যা বিধিনিষেধ বা অন্যের প্রত্যাশাকে লঙ্ঘন করে। এটি অননুমোদিত এবং শাস্তি বিধানের ব্যাপারে আগ্রহী। (Theterm ‘deviance’ is used to refer to behaviour which infringe rules or the expectations of others and which attracts disapproval or punishment).

অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্যঃ

বিচ্যুতি বলতে সমাজের রীতিনীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ ভঙ্গ করাকে বোঝায়। অন্যদিকে আইন ভঙ্গমূলক কাজকে অপরাধ বলে। অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য নিচে দেখানো হয়েছে-

১. রাষ্ট্র বা আইন কর্তৃক অননুমোদিত কাজ হচ্ছে অপরাধ। অন্যদিকে, সাধারণ অর্থে মানুষের যেসব আচরণ সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী, সমাজে অসংগতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাকে বিচ্যুত আচরণ বলে।

২. আইন ভঙ্গমূলক কাজ হচ্ছে অপরাধ, অন্যদিকে বিচ্যুতি হচ্ছে সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ।

৩. বিচ্যুতি ও অপরাধ ঘনিষ্ঠ হলেও এরা এক নয়, প্রকৃতপক্ষে বিচ্যুতির ধারণা অপরাধের চেয়েও বড়।

৪. অপরাধ হলো শুধু আইনের লঙ্ঘন। অপরাধের শাস্তি রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত। সে শাস্তি হতে পারে লঘু অথবা গুরু; অন্যদিকে, বিচ্যুতি হচ্ছে সেই আচরণ, যা আইন লঙ্ঘন করে না, তবে বিচ্যুতিমূলক আচরণকে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকে। এর মাধ্যমে সামাজিক সংহতি কিছুটা হলেও বিনষ্ট হয়।

৫. বিচ্যুত আচরণের জন্য অনেক সময় তিরস্কারসহ সামাজিক শাস্তি প্রদান করা হয়। অন্যদিকে, অপরাধের জন্য সামাজিক শাস্তি নয়, আইনের বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

৬. অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ভ‚মিকা অধিকতর কার্যকর। তবে সামাজিক আন্দোলন এবং সচেতনতাও প্রয়োজন। অন্যদিকে, বিচ্যুত আচরণ নিয়ন্ত্রণে পরিবার এবং সমাজের ভূমিকাই যথেষ্ট।

৭. অপরাধ লিখিত, কোনটি অপরাধ এবং তার জন্য শাস্তি কী হবে তা লিখিতভাবে জারি করা হয়। অন্যদিকে, বিচ্যুতি প্রায়শ অলিখিত এবং যুগ যুগ ধরে প্রচলিত।

৮. অধিকাংশ ক্ষেত্রে সব সমাজ ও সংস্কৃতিতে অপরাধের ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য থাকে না। হত্যা, ধর্ষণ, চুরি সর্বত্রই অপরাধ হিসেবে গণ্য। তবে দেশভেদে শাস্তির পার্থক্য রয়েছে। একই অপরাধে কোনো দেশ অপরাধীর মৃত্যুদন্ড দিতে পারে আবার কোনো কোনো দেশ নির্দিষ্ট মেয়াদে মৃত্যুদন্ড দিতে পারে।

অন্যদিকে, সমাজ ও সংস্কৃতিভেদে বিচ্যুত আচরণে পার্থক্য দেখা যায়। একসমাজে যা বিচ্যুতি, অন্য সমাজে তা বিচ্যুতি না ও হতে পারে।