ডেঙ্গুজ্বর এখন আর শুধু ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ঢাকার বাইরেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব এখন প্রতি বছরই দেখা দিচ্ছে এবং প্রতিবারই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। প্রাথমিক প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে স্প্রে দিয়ে মশা নিধন তেমন কোনো কাজেই আসছে না। বরং এডিস মশা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আনছে এবং কামড়াচ্ছে দিন বা রাত যেকোনো সময়।
তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হচ্ছে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা। ডেঙ্গুজ্বরের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, নেই কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধও। ভ্যাকসিনই ডেঙ্গু প্রতিরোধের একমাত্র কার্যকরী ব্যবস্থা। সম্প্রতি জাপানের টাকেডা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ডেঙ্গুর নতুন জেনারেশনের ভ্যাকসিন কিউডেঙ্গা (টিএকে-০০৩) তৈরি করেছে, যা ডেঙ্গু প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী ও নিরাপদ। কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে জনসাধারণের ওপর প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছে।
এর আগে সানোফির তৈরি সর্বপ্রথম ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ডেংভ্যাক্সিয়া বাজারে এলেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উপরন্তু যারা পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি (সেরোনেগেটিভ), তাদের জন্য এই ভ্যাকসিনটি নিরাপদ নয়। এ ছাড়াও ৯ বছরের কম বয়সী শিশুরা এই ভ্যাকসিনের উপযুক্তও নয়। কম বয়সী শিশু ও যাদের পূর্বে ডেঙ্গু হয়নি তাদের এই ভ্যাকসিন দিলে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়—এটা এক ধরনের ভ্যাকসিনজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যা অ্যান্টিবডি-ডিপেন্ডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট নামে পরিচিত।
ডেংভ্যাক্সিয়া ও কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনের মধ্যে পার্থক্যঃ
ডেংভ্যাক্সিয়া ও কিউডেঙ্গা নামে ডেঙ্গুর দুটি ভ্যাকসিন রয়েছে। এ দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে অনেক ভুল ধারণাও রয়েছে। অনেকেই এ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং সেইফটি মার্জিনকে এক করে ফেলছেন। আসলে এ দুটি ভ্যাকসিনের মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য রয়েছে। তা নিচে আলোচনা করা হয়েছে-
★ ফ্রান্সের সানোফি ডেংভ্যাক্সিয়া তৈরি করেছে ইয়োলো ফিভার ভাইরাসকে ব্যাকবোন হিসাবে ব্যবহার করে। অন্যদিকে, জাপানের টাকেডা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন তৈরি করেছে; ডেঙ্গু ভাইরাস সেরোটাইপ-২ বা ডেনভি-২-কে ব্যাকবোন হিসাবে ব্যবহার করে।
★ দুটি ভ্যাকসিনই লাইভ অ্যাটেনিউয়েটেড ভ্যাকসিন, অর্থাৎ এখানে দুর্বলকৃত জীবন্ত ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে।
★ দুটি ভ্যাকসিনই টেট্রাভ্যালেন্ট। অর্থাৎ দুটি ভ্যাকসিনের মধ্যেই ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপের (ডেনভি-১ থেকে-৪) সার্ফেস এন্টিজেন সংযুক্ত করা হয়েছে।
★ ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণে আমাদের শরীরে হিউমোরাল বা অ্যান্টিবডি-মেডিয়েটেড এবং সেল মেডিয়েটেড উভয় ধরনের ইমিউনিটি তৈরি হয়। অ্যান্টিবডি মেডিয়েটেড ইমিউনিটি তৈরি হয় ডেঙ্গু ভাইরাসের সার্ফেস অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে আর সেল-মেডিয়েটেড ইমিউনিটি তৈরি হয় ভাইরাসটির নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিনের বিরুদ্ধে।
★ ডেংভ্যাক্সিয়াতে সংযুক্ত করা হয়েছে শুধু ডেঙ্গু ভাইরাসের সার্ফেস অ্যান্টিজেন যেখানে ডেঙ্গু ভাইরাসের নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিনের কোনো জিন নেই, আছে ইয়োলোফিভার ভাইরাসের নন-স্ট্রাকচারাল জিন। এর ফলে ডেংভ্যাক্সিয়া দিলে শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সাব-টাইপের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয় কিন্তু সেল মেডিয়েটেড ইমিউনিটি তৈরি হয় না। এ একপেশে ইমিউনিটির কারণে ডেংভ্যাক্সিয়া নেওয়ার পরে ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমণ হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করে। কেন এমন হয় তা খুব একটা পরিষ্কার না। তবে এ ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে বলে অ্যান্টিবডি-ডিপেন্ডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট।
অন্যদিকে, কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনটি ডেনভি-২ ভাইরাসের ব্যাকবোনের ওপরে তৈরি ফলে, এর ভেতরে ডেঙ্গু ভাইরাস-২ এর নন-স্ট্রাকচালার প্রোটিনের জিন রয়েছে। ফলে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন দিলে শরীরে অ্যান্টিবডি-মেডিয়েটেড ইমিউনিটির পাশাপাশি সেল-মেডিয়েটেড ইমিউনিটিও তৈরি হয়।
★ এ গঠনগত বৈসাদৃশ্যের কারণেই সম্ভবত সাড়ে চার বছর ধরে ২৮ হাজার শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক ভলান্টিয়ারের ওপর চালানো ১৯টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনে সানোফির ভ্যাকসিনটির মতো কোনো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা অ্যান্টিবডি-ডিপেন্ডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট দেখা যায়নি।
★ কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডে জনসাধারণে প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছে। তবে এখনো ইউএস এফডিএ বা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি।
অন্যদিকে, সানোফির ডেংভ্যাক্সিয়া ইউএস এফডিএ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ২০টি দেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত। তবে এ অনুমোদন অনুযায়ী ভ্যাকসিনটি শুধু দেওয়া যাবে ৬-১৬ বছরের বাচ্চাদের; যাদের আগে ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছে (সেরো পজিটিভ) এবং যাদের রক্তে এনএস-১ অ্যান্টিবডি রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এ ভ্যাকসিনটির দুটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়েছে শুধু ২-১৬ বছরের শিশুদের ওপর। ৫ বছরের ভ্যাকসিন সার্ভাইল্যান্সে দেখা গেছে এ ভ্যাকসিন দুই-পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে মারাত্মক ডেঙ্গুজ্বর হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় সাড়ে সাত গুণ।
★ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের অনুমোদন অনুযায়ী আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত (সেরোপজিটিভ) অথবা অনাক্রান্ত (সেরোনেগেটিভ) ৪ বছরের শিশু থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সের মানুষ কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন নিতে পারবে। তবে, ইন্দোনেশিয়ায় প্রাথমিকভাবে ৬ বছর থেকে ৪৫ বছরের সবাইকে এ ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
★ ডেংভ্যাক্সিয়া বা কিউডেঙ্গা কোনো ভ্যাকসিনই এখনো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি।
★ ডেংভ্যাক্সিয়ার ডোজ তিনটি। প্রথম ডোজ দেওয়ার পরে ৬ এবং ১২ মাস পরে আরও দুটি ডোজ নিতে হয়। অন্যদিকে, কিউডেঙ্গার ডোজ দুটি। দ্বিতীয় ডোজটি প্রথম ডোজের ৩ মাস পর নিতে হয়।
★ দুই ডোজের কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ডেঙ্গুজ্বর থেকে সুরক্ষা দেয় ৮০.২ শতাংশ এবং ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোধ করে ৯০.৪ শতাংশ। ভ্যাকসিনের সুরক্ষা নির্ভর করে কোনো সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়েছে তার ওপর। তবে, এ ভ্যাকসিনটি সিভিয়ার ডেঙ্গু এবং হেমোরেজিক ডেঙ্গু থেকে সাড়ে চার বছরের জন্য সুরক্ষা দেয় ৭০ শতাংশ, তা যে সেরোটাইপ দিয়েই সংক্রমণ হোক না কেন।
অন্যদিকে, সেরোপজিটিভ শিশুদের ক্ষেত্রে ডেংভ্যাক্সিয়া কার্যকর হলেও মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে এ ভ্যাকসিন গ্রহণে সবার মধ্যে কিছুটা সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোপরি বলা যায় জাপানের তৈরি নতুন ভ্যাকসিন কিউডেঙ্গা কার্যকরী এবং নিরাপদ যা সিভিয়ার ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা দেয় প্রায় ৭০ শতাংশ।
লেখক : সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, লেস্টার ইউনিভার্সিটি, ইউকে।