শিক্ষা হল একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া যা ব্যক্তির সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এর উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির জ্ঞান, দক্ষতা, মনোভাব ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো। শিক্ষা সাধারণত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত হয়। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ উভয়ই ব্যক্তির জ্ঞান, দক্ষতা ও আচরণের পরিবর্তন ঘটাতে সহায়তা করে। তবে, উভয়ের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-
শিক্ষা (Education)
শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ Education শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Educere থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ হলো নিষ্কাশন করা, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বা ভিতর থেকে বের করে আনা। বাংলা ‘শিক্ষা’ শব্দটি সংস্কৃত ধাতু শাস থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করা। শিক্ষা শব্দটি সমার্থক শব্দ বিদ্যা সংস্কৃত ধাতু বিদ থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো জানা বা জ্ঞান অর্জন করা। সাধারণ অর্থে, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনই হলো শিক্ষা। শিক্ষা একটি প্রক্রিয়া যেখানে জ্ঞান, দক্ষতা, মান, বিশ্বাস ও অভ্যাস অর্জন করা যায়। শিক্ষা অর্জন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়।
অ্যারিস্টটলের মতে, “শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীদের দেহমনের বিকাশ সাধন এবং তার মাধ্যমে জীবনের মাধুর্য ও সত্য উপলব্ধিকরণ।”
স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশই হলো শিক্ষা।”
ফ্রয়বেল-এর মতে, “শিক্ষা হলো অন্তর্নিহিত সত্তার সুপ্ত সম্ভাবনার উন্মেষ সাধন।”
অতএব, যে উপায়ে মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ সাধন ও আচরণের স্থায়ী পরিবর্তন ঘটানো হয় তাকে শিক্ষা বলা হয়।
প্রশিক্ষণ (Training):
প্রশিক্ষণ হচ্ছে একটি পরিকল্পিত কার্যক্রম। প্রশিক্ষণ গ্রহণের ফলে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করা হয়। প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে কোন ব্যক্তির জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন সাধন করে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে তার যোগ্যতার উন্নতি ও সমৃদ্ধি সাধন করা। প্রশিক্ষণটি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ দ্বারা সরবরাহ করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীরা অর্পিত কার্যগুলিতে ভাল সম্পাদন করার জন্য জ্ঞান অর্জন করে, তাদের দক্ষ দক্ষতা তীক্ষ্ণ করে তোলে, তাদের মনোভাব এবং দক্ষতার উন্নতি করে।
এর উদ্দেশ্য কারও ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং দক্ষতার উন্নতি করা বা তাকে পছন্দসই জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা। প্রশিক্ষণ নতুন স্নাতকদের কর্মজীবন, অফিস সংস্কৃতি, কারখানার পরিবেশ ইত্যাদির প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে প্রশিক্ষণ হ’ল মানবসম্পদ পরিচালনার একটি সরঞ্জাম, যা কর্মীদের বুনিয়াদি উন্নত করতে পারে এবং তাদের উন্নত করতে পারে এমন একটি উপায় যাতে তারা তাদের দায়িত্ব ও কাজগুলি কার্যকরভাবে সম্পাদন করতে পারে। প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু হলো প্রশিক্ষণার্থীরা দক্ষতার সাথে কার্য সম্পাদন করা।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে পার্থক্য:
১. শিক্ষা যুক্তিবোধ ও বিচার দক্ষতার বিকাশ সাধন। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ জ্ঞান ও দক্ষতার সাথে সাথে কার্যসম্পাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো।
২. শিক্ষা ব্যক্তির চিন্তন-মননের উৎকর্ষতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ পুরোপুরি বৃত্তি/পেশার সাথে সম্পৃক্ত, চিন্তনমননের বিকাশে তেমন ভূমিকা নেই।
৩. শিক্ষা সাধারণ জ্ঞান লাভের সাথে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ কোনো বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জনের সাথে জড়িত।
৪. শিক্ষা ভবিষ্যত চাকরির জন্য দরকার হয়। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ বর্তমান চাকরির জন্য দরকার হয়।
৫. শিক্ষা দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ স্বল্পকালীন প্রক্রিয়া।
৬. শিক্ষা ব্যক্তি-কেন্দ্রিক। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ কার্যকেন্দ্রিক।
৭. শিক্ষা ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভরশীল।
৮. শিক্ষা একজন ব্যক্তির সারা জীবন ধরে অব্যাহত থাকে। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ বিশেষ প্রয়োজনে ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে নতুন করে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়।
৯. শিক্ষা শ্রেণি শিক্ষণের সাথে জড়িত। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ চাকরির অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত।
১০. বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া হয়। অন্যদিকে, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষারও প্রচলন রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক বা ঘরোয়াভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।