পরিবেশ (Environment) :
পরিবেশ বলতে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বুঝায়। আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখি এবং যার প্রভাবে প্রভাবিত হই তাকে পরিবেশ বলে। আমাদের ঘরবাড়ী, আসবাবপত্র, ক্ষেতখামার, গাছ-পালা, জলবায়ু, খেলার মাঠ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, হাট-বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সকল কিছুর সমন্বয়ে যে ভৌগোলিক ও সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে পরিবেশ বলে। জীবন ও পরিবেশ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। মার্সটিন বেট্স এর মতে, “পরিবেশ হল সেই সকল বাহ্যিক অবস্থার সমষ্টি যা জীবনের বিকাশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।” জীবনের আশা-আকাঙক্ষা, সুখ-দুঃখ, সাফল্য, নৈরাশ্য, উৎসাহ, উদ্দীপনা ইত্যাদি সবকিছুই পরিবেশের দান।
বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) :
আমাদের চারপাশে যা কিছু রয়েছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। পরিবেশকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- জড় পরিবেশ ও জীব পরিবেশ। এ দুটি পরিবেশের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। জড় পরিবেশের মূল উপাদান হলো মাটি, পানি ও বায়ু। এ উপাদানগুলো জীবের আহার ও আশ্রয়ের যোগানদাতা। পরিবেশ আমাদের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বেঁচে থাকার সব ধরনের উপাদান জীব পরিবেশ থেকে পায়। বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের জীব গড়ে উঠে। যেমন- নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর প্রভৃতি জলচর প্রাণীর প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম কিন্তু এ পরিবেশে স্থলচর প্রাণীরা বেঁচে থাকতে পারে না। মরূভূমিতে পানির অভাব তাই সেখানে উদ্ভিদের সংখ্যা কম। এ পরিবেশে উদ্ভিদ বেশি একটা দেখা যায় না। জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ এ পরিবেশে দুষ্প্রাপ্য। আবার সুন্দরবনের লবণাক্ত পরিবেশে যে সকল জীব জন্মায় তা সিলেটের বা পার্বত্য অঞ্চলের বনভূমিতে দেখা যায় না। এ থেকে প্রতীয়মান যে, কোন একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশে যে সকল জীব জন্মায় বা বাস করে তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। এ রকম বিভিন্ন জীবের সমষ্টি নিয়ে গড়ে উঠে এক একটি জীব সম্প্রদায়।
প্রায় প্রতিটি জীব সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীব থাকে। এরা একে অন্যের সহযোগিতায় দলবদ্ধভাবে বেঁচে থাকে। কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জলবায়ু কেমন হবে তা নির্ভর করে ঐ অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠের অবস্থান এবং এর ভূপ্রকৃতির উপর। ঐ অঞ্চলের জলবায়ুর প্রভাবে সেখানকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্প্রদায় গড়ে উঠে। কোন স্থানের উদ্ভিদ, প্রাণী এবং এদের জড় পরিবেশ নিজেদের মধ্যে (যেমন- উদ্ভিদের সাথে উদ্ভিদের, প্রাণীর সাথে প্রাণীর) এবং পরস্পরের মধ্যে (যেমন- উদ্ভিদের সাথে প্রাণীর বা পরিবেশের) ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে অবস্থান করে। জীব ও তার পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলে এদের গঠন ও কার্যের পরিবর্তন সাধিত হয়।
সবুজ উদ্ভিদ বায়ু থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) ও মাটি থেকে পানি (H2O) সংগ্রহ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তাদের প্রধান খাদ্য কার্বোহাইড্রেট (শর্করা) তৈরির সময় অক্সিজেন (O2) ত্যাগ করে। উদ্ভিদ ও প্রাণী শ্বসনের জন্য যতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন তার একটি বড় অংশ আসে ঐ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া থেকে। কোনো স্থানের জীব (উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি) ও এদের পরিবেশ নিজেদের মধ্যে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার গতিময় পদ্ধতিকে বাস্তুতন্ত্র বলা হয়।
পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্যঃ
১. ‘এনভায়রনমেন্ট’ শব্দটির উৎপত্তির পেছনে ফরাসি (Environ), জার্মান (Umgebung) ও ড্যানিশ (Umwelt) ভাষার তিনটি শব্দ দায়ী। ইংরেজ দার্শনিক, জীববিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ, কবি ও সমাজবিজ্ঞানী হাবার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) ‘এনভায়রনমেন্ট’ শব্দটিকে ‘জীব-বাতাবরণ মিথস্ক্রিয়া’ অর্থে ব্যবহার করে ইংরেজি ভাষার মানুষের কাছে জনপ্রিয় করেন। বর্তমানে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, মেরিয়াম ওয়েবস্টারসহ বেশির ভাগ অভিধানে ‘এনভায়রনমেন্ট’ শব্দটিকে স্পেনসার প্রদত্ত ধারণার ওপর ভিত্তি করে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ‘ইকোসিস্টেম’ শব্দটির বাংলা কখনো ‘প্রতিবেশব্যবস্থা’ কিংবা শুধু ‘প্রতিবেশ’ হতে পারে না। ‘ইকোসিস্টেম’ শব্দটি ১৯৩৪ সালের আগে ছিলও না। ব্রিটিশ ইকোলজিস্ট স্যার আর্থার জর্জ ট্যানসিল (১৮৭১-১৯৫৫) ১৯৩৫ সালে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। জানা যায়, তিনি এক জুনিয়র গবেষকের কাছ থেকে জীব ও তার ‘এনভায়রনমেন্ট’-এর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বোঝাতে শব্দটি পেয়েছিলেন।
২. পরিবেশ বলতে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বুঝায়। আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখি এবং যার প্রভাবে প্রভাবিত হই তাকে পরিবেশ বলে। অন্যদিকে, কোনো স্থানের জীব (উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি) ও এদের পরিবেশ নিজেদের মধ্যে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার গতিময় পদ্ধতিকে বাস্তুতন্ত্র বলা হয়।
৩. পরিবেশ আমাদের আশেপাশের জিনিসগুলি বোঝায় এবং এটি জীবগুলি অন্তর্ভুক্ত করে না। অন্যদিকে, যখন আমরা শব্দটি শব্দ ব্যবহার করি, তখন আমরা ভুলভাবে করি যখন আমরা বলি বাস্তুতন্ত্র। ইকোসিস্টেমটি একটি স্বতন্ত্র সিস্টেমকে বোঝায়, যা উভচর ও জৈবিক উভয় উপাদান এবং একে অপরের সাথে তাদের সম্পর্কের অন্তর্গত।
৪. পরিবেশ’ বলতে বুঝব, যে অবস্থার মধ্যে জীব (প্রাণী, উদ্ভিদ, অণুজীব) বাস করে কিংবা কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে, সেটিই তার/তাদের পরিবেশ। এটি যদি আমরা মানি, তাহলে পরিবেশ শব্দটির সমার্থক হিসেবে ‘প্রতিবেশ’ শব্দটি ব্যবহার করা যায় না। কারণ ‘প্রতিবেশ’ শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে ‘স্বগৃহপার্শ্বস্থ গৃহ’ কিংবা ‘প্রতিবাসিগৃহ’। ‘স্বগৃহ’ কিংবা ‘গৃহ’ হলে এটি হয়তো ব্যবহার করা যেত।
অন্যদিকে, ‘কোনো একটি জায়গার (তাত্ত্বিকভাবে অণু থেকে মহাবিশ্ব) সব জীব ও তাদের মধ্যের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপ এবং তাদের সঙ্গে অজীব উপাদানগুলোর (বায়ু, পানি, মাটি, সূর্য, আবহাওয়া, বায়ুমণ্ডল ইত্যাদি) সম্পর্ক।’ এই সংজ্ঞা ‘প্রতিবেশ’ সম্পর্কিত ওপরে দেওয়া অর্থগুলোর কোনোটির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। কাজেই যৌক্তিক কারণেই ‘ইকোসিস্টেম’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ ‘প্রতিবেশ’ করা যায় না।
৫. ‘পরিবেশ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘বেষ্টন’, ‘পরিবৃতি’, ‘মণ্ডল’, ‘বৃত্তপ্রান্ত’, ‘পরিধি’ ইত্যাদি। অন্যদিকে, ‘বাস্তুতন্ত্র’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘যে স্থানে বসতি করে’, ‘বসতি বাটী’, ‘বাসস্থান’ ইত্যাদি