ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের মধ্যে পার্থক্য

ফ্যাসিবাদ (Fascism):

ফ্যাসিবাদ হল একটি স্বৈরশাসকের নেতৃত্বে সরকারের একটি ব্যবস্থা যারা সাধারণত জোরপূর্বক এবং প্রায়শই হিংসাত্মকভাবে বিরোধী ও সমালোচনাকে দমন করে, দেশের সমস্ত শিল্প ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে, জাতীয়তাবাদ এবং প্রায়শই বর্ণবাদকে প্রচার করে। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে র‍্যাডিক্যাল কর্তৃত্বমূলক জাতীয়তাবাদের একটি রূপ। যা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপে খ্যাতি লাভ করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে ফ্যাসিবাদ উৎপত্তি লাভ করে জাতীয় সিন্ডিক্যালবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। ইতালিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি বেনিটো মুসোলিনি (১৮৮৩- ১৯৪২) Fascismo নামে যে মতাদর্শ ও আন্দোলনের সূত্রপাত ও প্রচলন করেন তার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Fascism। মুসোলিনি লিখেছেন, ‘ফ্যাসিবাদ হলো একাধারে কর্ম ও চিন্তা’। এটি বিশেষভাবে বামপন্থী রাজনীতির উপাদান গ্রহণের মাধ্যমে ডানপন্থী রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণ করে; এবং এটি ছিল সমাজতন্ত্র, উদারতাবাদ, সাম্যবাদ, ডানপন্থী রক্ষণশীল, গণতান্ত্রিকের বিরোধী।

যদিও ফ্যাসিবাদকে বাম-ডান রাজনীতিতে সাধারণভাবে দূর ডানে জায়গা দেয়া হয়, কতিপয় স্ব-ব্যাখ্যাত ফ্যাসিবাদী এবং কিছু মন্তব্যকারীরা বলেছেন যে এই বিবরণ যথার্থ নয়। এটি মুলত রাষ্ট্রের সকল মানুষকে একাত্ব করে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই কাজে তারা নির্ভর করে একটি বিশেষ বাহিনী বা গোষ্ঠীর উপর যারা পূর্বে রাজনৈতিক অঙ্গনে ততটা প্রভাবশালী ছিল না। যাদের এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা থাকে তারাই পরবর্তীকালে রাষ্ট্র নেতৃতে অগ্রনী দায়িত্ব নেয়।

ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী জনগণের সামনে সোনালি অতীতের গল্প হাজির করে এবং জাতিকে সেই সোনালি অতীতের মতো উজ্জল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। ফ্যাসিবাদের মূল সুবিধাভোগী হয় শহর কেন্দ্রীক শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলো এবং সিভিল ও সামরিক আমলাতন্ত্র। ফ্যাসিবাদ যখন নিরাপদ ও শক্তিশালী অবস্থানে উপনীত হয়, তখন নাগরিক ও সামরিক প্রশাসন কোন একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসায় এবং রক্ষা করে এ উদ্দেশ্যে যে রাজনৈতিক গোষ্ঠীটি তাদের সমস্ত কর্মকান্ডের আইনগত, রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগত বৈধতা দিবে।

নাৎসিবাদ (Nazism):

নাৎসিবাদ নামে পরিচিত একটি রাজনৈতিক মতবাদ, যা বিংশশতকের প্রথমার্ধে জার্মানিতে উদ্ভূত নাৎসি পার্টির সাথে সম্পর্কিত। এটাকে সাধারণত একধরনের ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক কৌলিবাদ, ইহুদিবিদ্বেষ অন্তর্ভুক্ত। এডলফ হিটলারকে নাৎসিবাদের প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এটা জার্মানির রাষ্ট্রীয় মতবাদ ছিল। জার্মানির ইতিহাসে এ সময়টাকে নাৎসি জার্মানি হিসেবে অভিহিত করা হয়। দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, শিল্পবাণিজ্যে মন্দা, জনস্ফীতি, খাদ্যসংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি নানান সমস্যার কারণে মানুষের জীবন যখন দুর্বিষহ হয় ওঠে ও ভার্সাই সন্ধির অপমানজনক শর্তগুলো জার্মানদের মধ্যে গভীর উত্তেজনা ও প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তুলছে, তখন ইটালির অনুকরণে জার্মানিতেও নাৎসি নামক এক শক্তিশালী দলের উদ্ভব হয় । ফ্যাসিস্টদের মতো নাৎসিরাও ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ও গণতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ।

দেশে জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করাই ছিল নাৎসিদের লক্ষ্য । ইটালির মতো যুদ্ধবিদ্ধস্ত জার্মানিতেও সর্বক্ষেত্রে সংকট প্রকটরূপে দেখা দেয় । ভার্সাই সন্ধির শর্তাবলি একদিকে যেমন জার্মানিকে সবদিক থেকে আঘাত হানে অন্যদিকে চুক্তির অপমানজনক শর্তাবলি জার্মানদের অন্তরে প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা তীব্র করে তোলে । জার্মানির ভাইমার প্রজাতন্ত্র সাম্যবাদী আদর্শকে ঠেকালেও জনগণের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে বা তাদের নতুন আশা আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে পারছিল না।

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের মধ্যে পার্থক্যঃ

নাৎসিবাদ নামে পরিচিত একটি রাজনৈতিক মতবাদ, যা বিংশশতকের প্রথমার্ধে জার্মানিতে উদ্ভূত নাৎসি পার্টির সাথে সম্পর্কিত। ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-

১। ফ্যাসিবাদ হল একটি স্বৈরশাসকের নেতৃত্বে সরকারের একটি ব্যবস্থা যারা সাধারণত জোরপূর্বক এবং প্রায়শই হিংসাত্মকভাবে বিরোধী ও সমালোচনাকে দমন করে, দেশের সমস্ত শিল্প ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে, জাতীয়তাবাদ এবং প্রায়শই বর্ণবাদকে প্রচার করে। অন্যদিকে, নাৎসিবাদ নামে পরিচিত একটি রাজনৈতিক মতবাদ, যা বিংশশতকের প্রথমার্ধে জার্মানিতে উদ্ভূত নাৎসি পার্টির সাথে সম্পর্কিত।

২। ফ্যাসিবাদ একটি শব্দ যা মূলত মুসোলিনির অধীনে ইতালির ফ্যাসিস্টদের কাছে পরিচিত ছিল। অন্যদিকে, নাৎসিবাদ, জাতীয় সমাজতন্ত্র হিসাবে পরিচিত, নাৎসি পার্টি একটি মতাদর্শিক ধারণা হয়।

৩। নাৎসিবাদের প্রথম দিক ছিল কঠোর ইহুদী বিদ্বেষ। অন্যদিকে, ফ্যাসিবাদীরা নাৎসিদের মতো এতটা ইহুদী বিদ্বেষী ছিল না।

৪। নাৎসিবাদের দেশ জার্মানিতে হিটলার ছিলেন সব কিছুর মূল। অন্যদিকে, ফ্যাসিবাদীদের মূল মুসোলিনি হলেও এখানে রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।

৫। নাৎসিবাদ ছিল চরম নির্মমতার আঁতুড়ঘর। অন্যদিকে, ফ্যাসিবাদ নাৎসিদের মতো এত নির্মম ছিল না।

৬। ধর্মনীতির দিক থেকে বিচার করলে মুসোলিনির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদ অনেক বেশি পরিমাণে জনপ্রিয় হতে পেরেছিল। অন্যদিকে, হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাৎসি দল ফ্যাসিবাদের মত অত বেশি পরিমাণে সফলতার মুখ দেখতে পায়নি।