প্রথাগত ও প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য

প্রথাগত শিক্ষা এবং প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা দুটি ভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি, যার প্রতিটির নিজস্ব সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে। নিচে প্রথাগত ও প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার মধ্যে পার্থক্যগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে-

প্রথাগত শিক্ষা (Formal Education) :
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জে.পি নায়েক বলেছেন, সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত হয়, তাকে নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষা বলে। আদিম সমাজব্যবস্থায় মানুষের জীবন ছিল সরল। তাই সে যুগে প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়নি। গৃহপরিবেশে পরিবারই শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সমাজজীবনে জটিলতা বৃদ্ধির কারণে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটলে মানুষ বুঝতে পারে যে, প্রশিক্ষণ ছাড়া ওই সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ফলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়। ধীরে ধীরে গড়ে উঠে প্রথাগত শিক্ষা (Formal Education)।

প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা (Non-formal Education) :
প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা হল নিয়ন্ত্রিত এবং অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাঝামাঝি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যা নির্দিষ্ট বিদ্যালয়ের সময়সুচির বাইরে অনুষ্ঠিত হয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা অর্জনের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করে। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে যে-কোনাে সংগঠিত বিধিবদ্ধ শিক্ষামূলক কাজকে প্রথাবহির্ভূত বা বিধিমুক্ত শিক্ষা বা নিয়মবহির্ভূত শিক্ষা বলে।

পিএইচ কুম্বস (P H Coombs)-এর মতে, প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা বলতে বােঝায় নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা কাঠামাের বাইরে অনুষ্ঠিত একটি সুসংগঠিত শিক্ষাক্রম, যেখানে বিশেষ জনসমষ্টির বয়স্ক ও শিশুদের জন্য নির্বাচিত বিশেষ ধরনের শিক্ষার সুযােগ সৃষ্টি করা হয়।

প্রথাগত ও প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার মধ্যে পার্থক্যঃ
১. বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জে.পি নায়েক বলেছেন, সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত হয়, তাকে নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষা বলে। অন্যদিকে, জে. পি. নায়েক বলেছেন, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা হল এমন এক সংগঠিত শিক্ষা প্রক্রিয়া যা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বাইরে সংঘটিত হয়। এই শিক্ষার উপাদানগুলি নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার থেকে কম নিয়ন্ত্রণে থাকে।

২. প্রথাগত শিক্ষার নিয়ম-কানুন কঠোর প্রকৃতির হয়ে থাকে। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার নিয়ম কানুন নমনীয় প্রকৃতির হয়ে থাকে।

৩. প্রথাগত শিক্ষার উদ্দেশ্য গুলি হল – নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রদান করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখা, নির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা স্থাপন, নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতার পরিমাপ।

অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার উদ্দেশ্য গুলি হল – বিদ্যালয় ছুট শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় সহায়তা প্রদান, আর্থিক দিক থেকে অনুন্নত শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ, প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, গ্রামীণ অঞ্চলে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

৪. প্রথাগত শিক্ষা নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার নির্দিষ্ট কোন বয়সসীমা নেই।

৫. প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষাদান পদ্ধতি শিক্ষক শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সংগঠিত হয়। অর্থাৎ এটি প্রত্যক্ষ নির্ভর শিক্ষাদান পদ্ধতি। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষায় শিক্ষাদান পদ্ধতি স্বয়ং শিখন প্রকৃতির। অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে নিজের চেষ্টায় জ্ঞান অর্জন করতে হয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া এখানে পরিলক্ষিত হয় না।

৬. প্রথা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট থাকে। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনির্দিষ্ট।

৭. প্রথাগত শিক্ষা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অর্থাৎ এই শিক্ষা সারা জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।

৮. প্রথাগত শিক্ষা সংকীর্ণ প্রকৃতির বা এটি সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা ব্যাপক প্রকৃতির বা এটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়।

৯. প্রথাগত শিক্ষা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়।

১০. প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষার শেষে শিক্ষার্থীরা সার্টিফিকেট বা ডিগ্রী লাভ করে থাকে। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষায় শিক্ষা কেন্দ্রগুলি শিক্ষার শেষে সার্টিফিকেট প্রদান করে।

১১. প্রথাগত শিক্ষা সম্পন্ন হয় বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের মধ্যে বা নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। তবে বিভিন্ন স্টাডি সেন্টার বর্তমান।

১২. প্রথাগত শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষাদান কার্যসম্পন্ন হয়। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষায় শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া সংঘটিত হয় না। ফলে শিক্ষকের প্রয়োজন নেই বললেই চলে।

১৩. প্রথাগত শিক্ষার অন্যতম সংস্থা হল বিদ্যালয়। অন্যদিকে, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার সংস্থা হল – মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও দূর শিক্ষার প্রতিষ্ঠান।