হরপ্পা সভ্যতা (Harappan Civilization):
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ বৎসর বা তার আগে থেকে যে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকেই সিন্ধু সভ্যতা নামে অভিহিত করা হয়। হরপ্পা সভ্যতা এই সিন্ধু সভ্যতার অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। হরপ্পা হলো- বর্তমান পাকিস্তানের সাহিবাল থেকে ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে নদীর পুরনো খাদের কাছে অবস্থিত একটি স্থান। ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে একটি রেলস্টেশন ছিল। বর্তমানে এটি একটি ছোট পাকিস্তানি শহর।
এই সভ্যতার অনুসন্ধানের সূত্রপাত ঘটেছিল খ্রিষ্ট্রীয় ১৮০০ শতকের প্রথম দিকে। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে ধারবাহিক অনুসন্ধানের ফলে এই সভ্যতা সম্পর্কে বিস্ময়কর দিকগুলো উন্মোচিত হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকগণ হরপ্পা অঞ্চলে খনন শুরু করেন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে। হরপ্পার অবস্থান বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবের সাহিওয়াল জেলায়। মহেঞ্জোদারো অঞ্চলে খনন কাজ শুরু হয় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। পাকিস্তানের অন্তর্গত সিন্ধুদেশে লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারোর অবস্থান। এরপর থেকে ক্রমাগত খনন কাজ চলতে থাকে এবং ধীরে ধীরে বেরোতে থাকে এই সভ্যতার বিস্ময়কর সব নিদর্শন। হরপ্পার চেয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শন মহেঞ্জোদারোতে বেশি পাওয়া যায়। এ কারণে ঐতিহাসিকদের অনেকে সিন্ধু সভ্যতাকে মহেঞ্জোদারো সভ্যতা বলেছেন। আবার কারও বর্ণনায় হরপ্পার সংস্কৃতি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। তাঁদের নিকট সিন্ধু সভ্যতা হরপ্পা সংস্কৃতি নামে পরিচিত।
বৈদিক সভ্যতা (Vedic Civilisation):
বৈদিক সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা গুলোর মধ্যে অন্যতম। সুমেরীয় সভ্যতার পরেই বৈদিক সভ্যতার বিকাশ হয়। সেই হিসাবে বৈদিক সভ্যতার উদ্ভব মিশরীয় সভ্যতা এবং রোমান ও গ্রিক সভ্যতার কয়েক হাজার বছর আগে । বৈদিক সভ্যতার সুচনা আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। তবে সব চাইতে আকর্ষনীয় ব্যাপার হল বৈদিক সভ্যতার নিদর্শন, বিশেষতঃ সাহিত্য ও ধর্মী বিষয়াদি আজও খুজে পাওয়া যাবে। বর্তমানে সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি বৈদিক সভ্যতা থেকে।
আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ও আর্য সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল বলে মনে করা হয় । কিন্তু উভয় সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক, কোনটি আগে, কোনটি পরে বা আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা কিনা, আর্যদের আদি বাসস্থান ভারতে, না তারা বহিরাগত- এই সব প্রশ্ন নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার অন্ত নেই । এসব প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো উত্তর হয় না । বেদ ছিল আর্য মনীষার প্রধান ফসল এবং বেদ থেকেই আমরা আর্য সভ্যতার পরিচয় পাই । তাই এই সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা বলা হয় । ঋক্ বেদের সময় থেকেই ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয় । ঋক্ বেদ কবে রচিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না । ম্যাক্সমুলারের মতে, এর রচনা কাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে । বালগঙ্গাধর তিলকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ । দ্বিতীয় মতটি কেউই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না । যাই হোক, সাধারণভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে ঋক্ বেদ রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয় । এই যুগকে তাই ঋক্ বৈদিক যুগ বলা হয় । ঋক্ বৈদিক যুগের পরবর্তী যুগকে বৈদিক যুগ বলা হয় ।
হরপ্পা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে পার্থক্যঃ
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ বৎসর বা তার আগে থেকে যে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। হরপ্পা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-
১. মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ বৎসর বা তার আগে থেকে যে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকেই সিন্ধু সভ্যতা নামে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে, বৈদিক সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা গুলোর মধ্যে অন্যতম। সুমেরীয় সভ্যতার পরেই বৈদিক সভ্যতার বিকাশ হয়।
২. হরপ্পা সভ্যতা ছিল বৈদিক সভ্যতার পূর্ববর্তী সভ্যতা (সময়কাল আনুমানিক ৩,০০০ থেকে ১,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। অন্যদিকে, বৈদিক সভ্যতা ছিল হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী সভ্যতা (সময়কাল আনুমানিক ১,৫০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।
৩. হরপ্পা সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। অন্যদিকে, বৈদিক সভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা।
৪. হরপ্পা সভ্যতার অর্থনীতির ভিত্তি ছিল বাণিজ্যকেন্দ্রিক অর্থাৎ এই সভ্যতা একটি বাণিজ্যক সভ্যতা ছিল। অন্যদিকে, বৈদিক সভ্যতার অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি ও পশুপালন কেন্দ্রিক।
৫. হরপ্পা সভ্যতার সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। অন্যদিকে, বৈদিক সভ্যতার সমাজ ব্যবস্থা ছিল পিতৃতান্ত্রিক।
৬. হরপ্পা সভ্যতার ধর্মে মাতৃদেবীর প্রাধান্য ছিল। অন্যদিকে, বৈদিক সভ্যতার ধর্মে পুরুষ দেবতার প্রাধান্য ছিল।
৭. হরপ্পা সভ্যতায় ষাঁড়কে পূজা করা হত। অন্যদিকে, বৈদিক সভ্যতায় গাভীকে পূজা করা হত।
৮. হরপ্পা সভ্যতার মানুষদের লোহা এবং ঘোড়ার ব্যবহার জানা ছিল না। অন্যদিকে, বৈদিক সভ্যতার মানুষদের লোহা ও ঘোড়ার ব্যবহার জানা ছিল।
৯. হরপ্পা সভ্যতার মানুষদের লিপির ব্যবহার জানা ছিল। অন্যদিকে, বৈদিক সভ্যতার আদি যুগের মানুষদের লিপির ব্যবহার জানা ছিল না।