ইজমা (Ijma):
ইজমা (إجماع) একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ কোন বিষয়ে সকল জনগণ একমত হওয়া। ইজমাঃ ইজমা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর ‘আলেমদের অথবা মুজতাহিদদের ইসলামী শরিয়তের কোনো একটি বিষয় যে বিষয়ে সুস্পষ্ট কুরআন ও হাদিসের নস বা দলীল নেই এ ধরনের কোনো একটি বিষয়ে সমস্ত উলামায়ে কিরামের কোনো এক যুগে একত্রিত হয়ে ঐক্যমতে পৌছার নাম। এটা শুধুমাত্র আইম্মাতুল ইজতিহাদ বা যারা ইজতিহাদ করে থাকেন তাদের অর্থাৎ মুজতাহিদ ‘আলেমগণই করবেন। এটি বিভিন্ন যুগে বা বিভিন্ন সময়ে হতে পারে। ঐ যুগের মুজতাহিদ ‘আলেমরা একত্রিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে যখন ঐক্যমতে পৌছবে তখনই মূলত ইজমা সাব্যস্ত হবে।
তবে যে বিষয়ে সুস্পষ্ট নস বা দলীল রয়েছে সে বিষয়ে ইজমা বৈধ নেই। শুধুমাত্র যে সমস্ত বিষয়ে কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট নস বা দলীল নেই কিন্তু কিছু নির্দেশনা পাওয়া যায় সেটিকে সামনে নিয়ে ঐ সময়ের শ্রেষ্ঠ ‘আলেমগণ যদি কোনো বিষয়ে ঐক্যমতে পৌছেন এবং ঐক্যমতে পৌছার পর তাদের যেই বক্তব্য থাকে এটাকেই ইজমা বলা হয়ে থাকে।
কিয়াস (Qiyas):
কিয়াস (আরবি: قياس) হল ইসলামি আইনশাস্ত্রের চতুর্থ উৎস। কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার পর এর অবস্থান। এই তিন উৎসতে সরাসরি নেই এমন কোনো বিষয়ের মাসয়ালা বা বিধান উৎসভিত্তিক অনুমান করে নির্ণয় করাকে কিয়াস বলে।
ইসলামী বিধিবিধান নির্ণয়ের জন্য প্রথমত কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা হয়। সহীহ হাদীস হল নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের থেকে বর্ণিত হাদীস। কুরআন, হাদীস, হাদীসের সনদ ও পরিভাষা, তাফসীর, উসুলুল ফিকহ, আরবি ব্যাকরণ ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিরা ইসলামের বিধিবিধান নির্ণয় করেন। কখনও কখনও এমন বিষয়ের বিধান নির্ণয় করার প্রয়োজন হয় যে বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসে সরাসরি কোনো বক্তব্য জানা থাকে না। এ ধরনের অবস্থায় কিয়াস বা অনুমানের উপর নির্ভর করে বিধিবিধান নির্ণয় করা হয়। তবে কিয়াসের ক্ষেত্রে অনেক মূলনীতি রয়েছে। সে মূলনীতি অনুসরণ করেই তাদের কিয়াস করতে হবে। কিয়াসের ক্ষেত্রে মৌলিক বিষয় হচ্ছে চারটি:-
১. যে মাস’আলার উপর আপনি কিয়াস করবেন সেটাকে মাকীস আলাইহি বলা হয় যে মাস’আলাটাকে আপনি কিয়াস করবেন অর্থাৎ যেই মাস’আলাতে সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে।
২. যেই মাস’আলাটি এর ক্ষেত্রে কিয়াস করে হুকুম প্রদান করবেন সেটাকে মাকিস বা কিয়াসকৃত মাস’আলা বলা হয়ে থাকে এই মাস’আলার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কোনো দলিল নেই তাই এই মাস’আলাটিকে সুস্পষ্ট দলীল নির্ভর মাস’আলার উপর কিয়াস করা হয়ে থাকে।
৩. এই দুইটি মমাস’আলার ক্ষেত্রে হুকুম প্রয়োগ করার জন্য যে কারণটি উল্লেখ করা হয়ে থাকে সেটাকে ‘ইল্লত বলা হয়। ‘ইল্লত হচ্ছে যে কারণে আপনি মাকিস আলাইহির হুকুমকে এ মাস’আলার উপর প্রয়োগ করবেন দুটি মাস’আলার সাথে সমন্বয় ও সাদৃশ্যতার কারণেই মূলত একই হুকুম দেয়া হয়ে থাকে আর সেই হুকুম নির্ভর করে ‘ইল্লতের উপর।
৪. এই দুটি মাস’আলার মধ্যে ‘ইল্লত বের করার যে প্রক্রিয়ার বা পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়ে থাকে তাকে তরীকাতুল ইজতিহাদ বলা হয়ে থাকে। ইস্তিমবাত বা ইজজতিহাদের এ পদ্ধতির সুনির্দিষ্ট মূলনীতিও শর্ত রয়েছে যার উপর নির্ভর করে মুজতাহিদ ‘আলেম দুটি মাস’আলার মাঝে সমন্বয়কারী ‘ইল্লত বের করে থাকেন।
ইজমা ও কিয়াসের মধ্যে পার্থক্যঃ
ইজমা (إجماع) একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ কোন বিষয়ে সকল জনগণ একমত হওয়া। ইজমা ও কিয়াসের মধ্যে পার্থক্য নিচে দেখানো হয়েছে-
১। ইসলামিক পরিভাষায় ইসলামি শারঈ বিষয় যেমনঃ মাসাইল ও আক্বীদায় যখন সকল ইসলামিক ইমামগণ একমত হন তখন তাকে ইজমা বলে। অন্যদিকে, কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার পর এর অবস্থান। এই তিন উৎসতে নেই এমন কোনো বিষয়ের মাসয়ালা বা বিধান অনুমান করে নির্ণয় করাকে কিয়াস বলে।
২। কুরআন ও সুন্নাহর কোন বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ না থাকলে ইজমার সাহায্যে তার সমাধান করা হয়। অন্যদিকে, কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান না পাওয়া গেলে কিয়াসের সাহায্য নেওয়া হয়।
৩। ইজমার মাধ্যমে আইন সৃষ্ট হয়। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম আইনের একটি বিরাট অংশ গড়ে উঠেছে উলামাগণের ঐক্যমতের ভিত্তিতে। অন্যদিকে, ‘কিয়াস’ কোন নীতি নির্ধারণ করে না; বরং প্রচলিত নীতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মাত্র।
৪। কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোন ইজমা গ্রহণযোগ্য হয় না। অন্যদিকে, কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার পরিপন্থী কোন কিয়াস হতে পারে না।
৫। তিন ধরণের ইজমা রয়েছে। যথা- (ক) আছহাবদের ইজমা; (খ) মুসলিম আইন বিষেজ্ঞদের ইজমা; এবং (গ) জনগণ কর্তৃক গঠিত ইজমা। অন্যদিকে, কিয়াস দুই প্রকারের। যথা- (ক) কিয়াস-ই-জলি বা সুস্পষ্ট; এবং (খ) কিয়াসে-ই-খাফই বা সুপ্ত।