জিহাদ (Jihad):
আভিধানিক অর্থে জিহাদ হলো পরিশ্রম,সাধনা,কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি। আক্ষরিক ভাবে জিহাদ শব্দটির অর্থ হলো কোনো বিষয়ে সংগ্রাম করা। এই সংগ্রাম সশস্ত্র বা অহিংস, ধর্মীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ, সব রকমেরই হতে পারে। যেমন, মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে আরবি ভাষায় জিহাদ বলেই অভিহিত করা হয়। একইভাবে নারীমুক্তির আন্দোলনকেও আরবি ভাষার বিভিন্ন প্রকাশনায় জিহাদ বলা হয়। কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য লাভের জন্য সমগ্র শক্তি নিয়োগ করাকে বোঝানো হয়। এর আভিধানিক অর্থ পরিশ্রম,সাধনা,কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি। তবে সচরাচর ইসলামী পারিভাষিক অর্থে ‘জিহাদ’ কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কুরআনে জিহাদের কথা ৪১ বার উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে “আল্লাহের পথে সংগ্রাম করা” অর্থে ‘জিহাদ’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। জিহাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে মুজাহিদ বলা হয়। জিহাদকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়।
প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড লুইসের মতে কুরআন ও হাদীসের অধিকাংশ জায়গাতেই জিহাদ শব্দটি ধর্মযুদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইসলামী পণ্ডিত ইয়াহিয়া ইবন শরাফ আল-নাদভী বলেছেন, “সমাজের সবার সামগ্রিক দায়িত্ব হলো ন্যায্য প্রতিবাদে অংশ নেয়া, ধর্মের সমস্যা দূর করা, স্রষ্টার আইনের কথা জানা, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা ও অন্যায়কে দূর করা।
ক্বিতাল (Qital):
ক্বিতাল (الْقِتَالُ) অর্থ ‘পরস্পরে যুদ্ধ করা’। বাবে মুফা‘আলাহর অন্যতম মাসদার। এই বাবের ক্রিয়াগুলোর অর্থ হচ্ছে একাধিক পক্ষের মধ্যে কিছু ঘটা। যেমন দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ। এক পক্ষ থেকে একতরফা আক্রমণ নয়। ক্বিতালের দ্বিতীয় অর্থ ‘প্রতিরোধ করা’। যেমন নামাজরত মুসল্লির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ হাদিসে বলা হয়েছে فَلْيُقَاتِلْهُ فَإِنَّهُ شَيْطَانٌ “তার উচিৎ ওকে ক্বিতাল করা । কেননা ওটা শয়তান।”[সূনান আন নাসাঈ ৪৮৬২]। ক্বিতা-ল অর্থ যদি শুধুই সশস্ত্র হামলা করা হতো, তাহলে আমরা নামাজের সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে তাকে হত্যা করে ফেলতাম।
ক্বিতালের অর্থ সীমিত, জিহাদের মতো ব্যাপক নয়। সব ক্বিতাল জিহাদ, সব জিহাদ ক্বিতাল নয়। কু’রআনের যেসব আয়াতে ক্বিতাল বলা হয়েছে সেগুলো সব জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হলেও সেগুলোর প্রত্যেকটির অর্থ প্রতিরোধ অথবা সশস্ত্র হামলা।
জিহাদ এবং ক্বিতালের মধ্যে পার্থক্যঃ
জিহাদ হলো পরিশ্রম,সাধনা,কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি। আক্ষরিক ভাবে জিহাদ শব্দটির অর্থ হলো কোনো বিষয়ে সংগ্রাম করা। জিহাদ এবং ক্বিতালের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-
আজকে জিহাদ এবং ক্বিতাল শব্দদুটোর ব্যাপক অপব্যবহার করা হচ্ছে। একদল সংগঠন কু’রআনের আয়াতগুলোতে জিহাদ এবং ক্বিতালের মধ্যে পার্থক্য না করে, জিহাদের জায়গায় ক্বিতাল করার প্রচারণা চালাচ্ছে। আরেকদল সংগঠন ক্বিতালের আয়াতগুলোকে সাধারণ জিহাদ অনুবাদ করে স্পষ্ট প্রতিরোধ এবং যুদ্ধের জায়গায় চুপচাপ বসে অপেক্ষা করা এবং অন্যায়ের সাথে আপোষ করে চলার জন্য প্রচারণা করছে।
এই দুই পক্ষই দাবি করে যে, যেহেতু জিহাদ এবং ক্বিতাল সমার্থক শব্দ, তাই এই শব্দ দুটোকে একে অপরের জায়গায় বদল করা যায়। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এরা আয়াতগুলোতে জিহাদের জায়গায় ক্বিতাল এবং ক্বিতালের জায়গায় জিহাদ সুবিধামত বসিয়ে, তাদের ইচ্ছেমত অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা করে, যেন তারা তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পারে। একারণে যখনই যুদ্ধ, সংগ্রাম, হত্যা ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো আয়াত বা হাদিস পাবেন, প্রথমেই দেখে নেবেন আরবিতে শব্দটা কি জিহাদ নাকি ক্বিতাল।
কুরআনে আল্লাহ تعالى অত্যন্ত সূক্ষ্ম আরবি ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি শব্দ বেছে নেওয়া হয়েছে এমনভাবে যে, সেই শব্দ ছাড়া অন্য কোনো সমার্থক শব্দ ব্যবহার করলে, সেই আয়াতে অর্থ বিকৃত করা যাবে, মানুষ ভুল কাজ করে ফেলবে। জিহাদের আয়াতে ক্বিতালের অর্থ করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ক্বিতালের আয়াতে জিহাদের অর্থ করলেও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে না, শান্তি আসবে না, মুসলিমদের অবস্থার পরিবর্তন হবে না। আরবিতে শব্দের সংখ্যা বিশাল। বেশিরভাগ শব্দের অনেকগুলো অর্থ হয় এবং অনেকগুলো সমার্থক শব্দ রয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, আরবিতে দুটো শব্দের ঠিক একই অর্থ হয় না, যদিও কিনা তারা সমার্থক। সমার্থক শব্দগুলোর অর্থের মধ্যে অবশ্যই কোনো না কোনো পার্থক্য রয়েছে। দুটো শব্দ কখনো সব ক্ষেত্রে ঠিক একই অর্থ বহন করে না।
যেমন ধরুন ‘প্রতিরোধ’ এবং ‘বিরোধিতা’ সমার্থক শব্দ। কিন্তু তাই বলে কি আমরা যে কোনো বাক্যে প্রতিরোধ-এর জায়গায় বিরোধিতা ব্যবহার করতে পারি? যেমন, “আমি এই ব্যাপারে তোমার বিরোধিতা করবো।” একে যদি কেউ লেখে, “আমি এই ব্যাপারে তোমাকে প্রতিরোধ করবো।” তাহলে এই দুই বাক্যের অর্থ পাল্টে যাবে। প্রথমটায় শান্তিপূর্ণ, নিরস্ত্র বিরোধিতা করার সুযোগ থাকবে, দ্বিতীয়টি হবে বল প্রয়োগ করে প্রতিরোধ করা।
ঠিক একইভাবে যেই আয়াতে জিহাদ শব্দ এসেছে, সেই আয়াতকে যখন ক্বিতালের আয়াত বানিয়ে ফেলা হবে, তখন মুসলিমরা যেই প্রেক্ষাপটে মারামারি ছাড়াও অন্য পথ নেওয়ার সুযোগ ছিল, সেখানে মারামারি করাটাই একমাত্র পথ হিসেবে নেবে। তখন হঠাৎ করে কু’রআনে বহু আয়াত হয়ে যাবে শুধুই মারামারি, যুদ্ধ করার আয়াত, অন্য কোনো ধরনের প্রতিরোধ, প্রতিবাদ করার আয়াত নয়। অথচ দেখা যাবে, সেই আয়াতগুলোতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে জিহাদ শব্দ ব্যবহার করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিরোধিতা, প্রতিরোধ, প্রতিরক্ষা করার আদেশ দিয়েছেন, যার অধিকাংশই হয়তো সশস্ত্র জিহাদ নয়।