যুক্তিবিদ্যা (Logic) :
যুক্তিবিদ্যার ইংরেজী প্রতিশব্দ Logic এসেছে গ্রীক শব্দ “Logos” থেকে । যার অর্থ চিন্তা বা শব্দ। সুতরাং বুৎপত্তিগতভাবে যুজতিবিদ্যা হলো চিন্তার বিজ্ঞান । কিন্তু যুক্তিবিদ্যা শব্দটা অনুসরণ করলে একে বরং ‘যুক্তির বিজ্ঞানই’ বলা উচিত এবং সচারচর তাই হয়ে থাকে । এলড্রিসের মতে, “যুক্তিবিদ্যা হলো যুক্তি বা ন্যায় পদ্ধতি ফলিত কলা”
হোয়েটলীর মতে, “যুক্তিবিদ্যা ন্যায় পদ্ধ্যতির কলা ও বিজ্ঞান” জেভনস যুক্তিবিদ্যাকে যুক্তি পদ্ধতির বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করেছেন ।
যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে এমন একটা বিষয়, যা অনুমানের যথার্থতা নির্ণয়ের জন্য অনুমান ও তার সহায়ক কতগুলো প্রক্রিয়া নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে আলোচনা করে। এ আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অসত্যকে বর্জন করে সত্যকে অর্জন করা। এ উদ্দেশ্যে যুক্তিবিদ্যা সঠিক যুক্তিপদ্ধতির কতগুলো নিয়ম প্রণয়ন করে, যার সাহায্যে যুক্তির বৈধতা ও অবৈধতা যাচাই করা যায়। যুক্তিবিদ্যায় প্রণীত এসব নিয়ম ছাড়া জ্ঞানের কোনো শাখাতেই যুক্তির বৈধতা যাচাই করা সম্ভব নয়। তবে বৈধতা বিচারকালে অনুমানের কিছু সহায়ক প্রক্রিয়া নিয়েও যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করে।
দর্শন (Philosophy) :
দর্শনের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Philosophy’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Philos’ ও ‘Sophia’ শব্দ দুটির সমন্বয়ে গঠিত। ‘Philos’ শব্দের অর্থ হলো to love এবং ‘Sophia’ শব্দের অর্থ হলো wisdom । তাহলে উৎপত্তিগত ভাবে Philosophy বা দর্শন শব্দের অর্থ হলো ‘জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ’ বা ‘জ্ঞানপ্রীতি’। মূলত সমগ্র বিশ্ব এবং জীবন সম্পর্কে একটা সুসংবদ্ধ ও যৌক্তিক জ্ঞান প্রদান করাই দর্শনের উদ্দেশ্য। তাই দর্শন সূবিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই বিশ্বজগৎ ও জীবন সম্পর্কে একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করে। অতএব বিচার এবং সমালোচনাই হলো দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বস্তুত দর্শন আমাদের জীবনের অর্থ, স্বরূপ , পরিণতি ও মূল্য নির্ধারণ করে। প্রকৃতপক্ষে দর্শন জীবন ও জগতের সকল সমস্যা চিহ্নিত করতে এবং তার সমাধান দিতে চেষ্টা করে।
দর্শনের এসব প্রয়াসের মধ্যে রয়েছে একটা সর্বমুখী স্বকীয়তা, তাৎপর্যময প্রকৃতি এবং সত্যের প্রতি এক মহতী অনুরাগ। দর্শন তার আলোচনায় ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার পরিসর অতিক্রম করে এক বিমূর্ত বা ইন্দ্রিয়াতীত জগতে প্রবেশ করে তার জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে চায়। তাই দর্শন হলো মানুষের এমন এক জ্ঞানীয় উপলব্ধি যা সর্বমুখী সত্যকে সামগ্রিকভাবে জানতে চায় এবং অন্য সকলের সামনে সেই সত্যকে তুলে ধরে। জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক নেই যা নিয়ে দর্শন আলোচনা করে না।
তাই দার্শনিক ওয়েবার এর মতে দর্শন হলো প্রকৃতি সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা গঠনের অনুসন্ধান, বস্তুসমূহের সার্বিক ব্যাখ্যার চেষ্টা। ড. কেয়ার্ড তাঁর Philosophy of Religion বইয়ে দর্শনের ব্যাপকতা সম্পর্কে বলেন যে, মানব অভিজ্ঞতার এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, বিশ্বজগতের এমন কোনো বস্তু বা সত্ত্বা নেই যা দর্শনের আওতা বহির্ভূত বা যা সম্পর্কে দর্শন অনুসন্ধান করে না।
যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্যঃ
যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন দুটি ভিন্ন জ্ঞানশাখা হলেও এদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। তবে, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্যও রয়েছে। পার্থক্য নিম্নরূপ-
১. যুক্তিবিদ্যা হলো দর্শনের একটি শাখা। অন্যদিকে, যুক্তিবিদ্যা দর্শনের অন্তর্ভূক্ত।
২. যুক্তিবিদ্যা হলো জ্ঞানের খন্ডিত আলোচনা। অন্যদিকে, দর্শন হলো জ্ঞানের সামগ্রিক আলোচনা।
৩. যুক্তিবিদ্যার পরিধি দর্শনের চেয়ে সংকীর্ণ। দর্শনের পরিসর ব্যাপক ও বিস্তৃত।
৪. যুক্তিবিদ্যা যথার্থ জ্ঞানের শর্তাবলি আলোচনা করলেও কখনো অভিজ্ঞতার জগতের বাইরে যেতে পারে না। অন্যদিকে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে দর্শন ইন্দ্রিয় জগত অতিক্রম করে অতীন্দ্রিয় সত্তার জগতে পৌঁছাতে পারে। কারণ দর্শন জড়, প্রাণ, মন, স্রষ্টা, আত্মা ইত্যাদি সব বিষয় নিয়েই আলোচনা।
৫. দর্শন সত্যতার জন্য যুক্তিবিদ্যার উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, যৌক্তিক পদ্ধতি দার্শনিক সমাধানের উপর নির্ভরশীল।
৬. যুক্তিবিদ্যা প্রক্রিয়ার প্রতি যত্নশীল। অন্যদিকে, দর্শন সিদ্ধান্তের প্রতি যতœশীল।