মেন্ডেলিফ পর্যায় সারণি (Mendeleef periodic table):
মেন্ডেলিফ তাঁর সময় পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৬৩টি মৌলকে পারমাণবিক ভরের বর্ধিত ক্রমানুসারে সাজিয়ে একটি সারণি তৈরী করেন। সারণিতে সমধর্মী মৌলসমূহ উলম্ব বা খাড়া স্তম্ভাকারে এবং ক্রম পরিবর্তনশীল ধর্মের মৌল ̧লোকে কয়েকটি অনুভূমিক সারিতে সাজানো হয়। খাড়া ̄স্তম্ভাগুলোকে গ্রুপ বা শ্রেণী এবং অনুভূমিক সারিগুলোকে পিরিয়ড বা পর্যায় বলা হয়। এই সারণিটিই মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি নামে পরিচিত। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিই আধুনিক পর্যায় সারণির ভিত্তিমূল রচনা করেছে এ কথা নি:সন্দেহে বলা যায়। পরবর্তী সময়ে (১৮৯০-১৯০০ সন) নিষ্ক্রিয় গ্যাসসমূহ আবিষ্কৃত হয়। পর্যায় সারণিতে এদের স্থান দিতে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিতে ৮টি শ্রেণী ও ১২টি পর্যায় ছিলে
একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পার হয়ে যেসব মৌল একই শ্রেণিতে পড়ে, তাদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের অনেক মিল দেখা যায় । বিভিন্ন মৌলের পারমাণবিক ভর (পারমাণবিক সংখ্যা) বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৌলগুলির ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের পর্যায়ক্রমে পুনরাবৃত্তি ঘটে— এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে মৌলগুলির যে শ্রেণি বিভাগ করা হয়েছে,তাকে পর্যায়গত বিভাগ এবং তালিকাকে পর্যায়-সারণি বলে।
আধুনিক পর্যায় সারণি (Modern Periodic Table):
যে মূলনীতির উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানী মেন্ডেলিফ মৌলসমূহকে সারণিতে সজ্জিত করেন তা ছিল মৌলিক পদার্থসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মবলী মৌলসমূহের পারমাণবিক ভর পরিবর্তনের পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। এ মূলনীতির উপর ভিত্তি করে মৌলসমূহকে সাজালে বাস্তবে কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। এই অসুবিধাসমূহ দূর করার লক্ষ্যে আধুনিক পর্যায় সারণি প্রকাশ করা হয়। আর সেই সারণিকে আধুনিক পর্যায় সারণি বলে।
আধুনিক পর্যায় সারণিতে মৌলসমূহকে ৭টি অনুভূমিক সারি বা পর্যায়ে এবং ৮টি খাড়া স্তম্ভ বা গ্রুপে সাজানো হয়েছে। পর্যায়সমূহকে ১ থেকে ৭ সংখ্যার সাহায্যে এবং গ্রুপ বা শ্রেণীসমূহকে I থেকে VII (রোমান সংখ্যা) ও ‘0’ (শূন্য) দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে। I থেকে VII পর্যন্ত শ্রেণী ̧লোকে A ও B উপশ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।
পর্যায়: প্রতিটি পর্যায় (১ম পর্যায় ব্যতিত) বাম দিক থেকে একটি ক্ষার ধাতু দিয়ে শুরু করে ডান দিকের সর্বশেষ শ্রেণী অর্থাৎ ‘0’ শ্রেণীতে একটি নিষ্ক্রিয় গ্যাস দিয়ে শেষ হয়।
১ম পর্যায়: এটি একটি অতি সংক্ষিপ্ত পর্যায় যাতে মাত্র দুটি মৌল H(1) ও He(2) আছে।
২য় ও ৩য় পর্যায়: এ দু‘টিকে সংক্ষিপ্ত পর্যায় বলা হয়। এদের প্রত্যেকটিতে ৮টি করে মৌল আছে। ২য় পর্যায়ে Li(3) থেকে Ne (10) এবং ৩য় পর্যায়ে Na(11) থেকে Ar(18) এই মৌলগুলি রয়েছে।
৪র্থ ও ৫ম পর্যায়: এ দু‘টো পর্যায় দীর্ঘ পর্যায় নামে পরিচিতি। ৪র্থ পর্যায়ে K(19) থেকে Kr (36) পর্যন্ত ১৮টি এবং ৫ম পর্যায়ে Rb(37) থেকে Xe (54) পর্যন্ত এই ১৮টি মৌল রয়েছে।
৬ষ্ঠ ও ৭ম পর্যায়: এ দু‘টোকে অতিদীর্ঘ পর্যায় বলা হয়। ৬ষ্ঠ পর্যায়ে Cs(55) থেকে Rn(86) পর্যন্ত ৩২টি মৌল রয়েছে। ৭ম পর্যায়টি অসম্পূর্ণ; যদিও এতেও ৩২টি মৌল থাকতে পারে। তবে Fr(87) থেকে Rg (111) পর্যন্ত ২১টি মৌল রয়েছে।
মেন্ডেলিফ এবং আধুনিক পর্যায় সারণির মধ্যে পার্থক্য:
মেন্ডেলিফ ৬৩টি মৌলকে পারমাণবিক ভরের বর্ধিত ক্রমানুসারে সাজিয়ে একটি সারণি তৈরী করেন। মেন্ডেলিফ এবং আধুনিক পর্যায় সারণির মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-
১। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি উপাদানগুলির পর্যায়ক্রমিক ফাংশনের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল, সেই সময়ে নিখোঁজ উপাদানগুলির ভবিষ্যতে অনুসন্ধানের জন্য জায়গা রেখেছিল। অন্যদিকে আধুনিক পর্যায় সারণি হলো এই মুহুর্তে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানগুলির বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে সাদৃশ্যগুলির অনুরূপ করার জন্য প্রচুর রসায়নবিদ এবং বিজ্ঞানীর কাজগুলির সম্মিলিত উন্নতি হিসাবে।
২। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি তাদের পারমাণবিক ওজনের উপর ভিত্তি করে উপাদানগুলি অর্ডার করে। অন্যদিকে আধুনিক পর্যায় সারণি তাদের পারমাণবিক সংখ্যার ভিত্তিতে উপাদানগুলিকে অর্ডার করে।
৩। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণীতে সেই সময় অনুপস্থিত উপাদানগুলির ফাঁক ছিল। অন্যদিকে আধুনিক পর্যায় সারণিতে এর মতো ধারণা নেই।
৪। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিতে 8 টি উল্লম্ব কলাম রয়েছে যাকে দলগুলি বলা হয় এবং 12 অনুভূমিক সারিগুলিকে পিরিয়ড বলা হয়। অন্যদিকে আধুনিক পর্যায়ক্রমিক সারণিতে 18 টি কলাম রয়েছে যাকে গ্রুপ বলা হয় এবং 7 টি সারি পিরিয়ড বলা হয়।
৫। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিতে মাঝে মাঝে একই গ্রুপে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত উপাদান রয়েছে। অন্যদিকে আধুনিক পর্যায় সারণির উপাদানগুলির নিয়মিত বিরতিতে পুনরাবৃত্তি একই ধরণের বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
৬। মেন্ডেলিফ পর্যায় সারণি আইসোটোপগুলির অস্তিত্বের সত্যতা সমর্থন করে না। অন্যদিকে আধুনিক পর্যায়ক্রমিক সারণি এই সত্যটিকে সমর্থন করে কারণ শ্রেণিবিন্যাসটি উপাদানের পারমাণবিক ওজনের চেয়ে পারমাণবিক সংখ্যার উপর ভিত্তি করে।
৭। মেন্ডেলিফ পর্যায় সারণী পারমাণবিক কাঠামোর ধারণাকে সমর্থন করে না। অন্যদিকে আধুনিক পর্যায়ক্রমিক সারণী উপাদানগুলিকে এমনভাবে গোষ্ঠীভুক্ত করে এই সত্যটিকে সমর্থন করে যাতে তাদের বৈদ্যুতিন কনফিগারেশনটি সহজেই অনুমিত করা যায়।