রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারঃ
রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা একটি গণতান্ত্রিক ও গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ব্যবস্থা, যেখানে সরকার প্রধান একটি নির্বাহী শাখায় নেতৃত্ব দেয় যা আইনসভা বা বিধানসভা বা সংসদসভা থেকে আলাদা হয়ে থাকে। সরকারের এই প্রধান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রেরও প্রধান হয়ে থাকেন, যিনি রাষ্ট্রপতি হিসাবে পরিচিত হন। রাষ্ট্রপতি শাসিত দেশে নির্বাহীগণ নির্বাচিত হয়ে থাকেন এবং এর জন্য আইন পরিষদ দায়ী নয়, যা সাধারণ অবস্থায় রদ করতেও পারবে না। ক্ষেত্রবিশেষে এ ধরনের রদ কার্যক্রম হয়, খুব কম ক্ষেত্র, অভিশংসনের মাধ্যমে।
“প্রেসিডেন্ট” তখনই এর কার্যকরতা লাভ করে যখন ওই পদাধিকারী ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে কোন গর্ভনিংবডির সভাপতিত্ব করেন, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা থেকে নির্বাহী ব্যবস্থা পৃথক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মহাদেশীয় কংগ্রেসের সভাপতির কার্যাবলী। রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ, আইন বিভাগের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে সংবিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি গৃহীত হওয়ার ফলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজকর্ম পরিচালনা করার সুযােগ পায়। রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থার যথার্থ উদাহরণ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, ফিলিপিনস ইত্যাদি দেশে এই শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান।
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারঃ
বর্তমানকালে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্রকে স্বাগত জানানো হয়েছে। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পার্লামেন্টারি বা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয়, উভয় ব্যবস্থাতেই সংসদীয় শাসন সমানভাবে জনপ্রিয়। যে সরকার ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং শাসন বিভাগের স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা আইন বিভাগের ওপর নির্ভরশীল তাকে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার বা সংসদীয় পদ্ধতির সরকার বলে।
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক এবং গভীর বোঝাপড়া থাকে। এরকম শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতিকে স্বীকার করা হয় না। উভয় বিভাগের মধ্যে এই পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সুশাসনের পথ প্রশস্ত হয়। এই শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভাই হল প্রকৃত শাসক। এই মন্ত্রিসভা আবার জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। ফলে জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারাই সরকারি নীতি নির্ধারিত হয় এবং শাসনকার্য পরিচালিত হয়। এতে গণতান্ত্রিক শাসন বা জনগণের শাসনের স্বরূপ বজায় থাকে।
সংসদীয় সরকারে মন্ত্রিসভাকে সরকারি নীতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে সকল বিষয়ে আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। তাই মন্ত্রিসভা স্বৈরাচারী হতে পারে না। এছাড়া, মন্ত্রিসভার জনস্বার্থ বিরোধী এবং স্বৈরাচারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিরোধী দল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা বিশেষভাবে নমনীয়। এরূপ শাসন ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে প্রয়োজনমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। প্রয়োজনের তাগিদে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদে পরিবর্তন আনয়নে অসুবিধা হয় না। এ ধরনের শাসনব্যবস্থা জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে। সরকারি নীতি, দেশের বিভিন্ন সমস্যা ও সরকারি কার্যক্রম নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা ও সমালোচনা হয়। তার মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে।
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্যঃ
১। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব শাসক এবং প্রকৃত শাসক এই দু’ধরনের শাসক দেখা যায়। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থার নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব কোন শাসক প্রধানের পদ থাকে না। রাষ্ট্রপতিই একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান এবং শাসন বিভাগের প্রধান কর্তা। তিনি তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।
২। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রকৃত প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ হল মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভার সকল সদস্য প্রত্যক্ষভাবে আইনসভার কাছে এবং পরোক্ষভাবে জনসাধারণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। তিনি জনগণের কাছেই দায়িত্বশীল থাকেন।
৩। সংসদীয় আইনসভার সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় একটি মন্ত্রিসভা থাকে। রাষ্ট্রপতিই এই মন্ত্রিসভার সদস্যদের মনোনীত ও নিযুক্ত করেন। মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির কাছে দায়িত্বশীল। রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির উপর তাদের কার্যকাল নির্ভরশীল।
৪। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ̄স্বার্থে অনেক সময় আইনীভাবেই একক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অন্যদিকে, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার মত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
৫। সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ও সংবিধান নমনীয়। প্রয়োজনমাফিক আইনগত কিংবা সাংবিধানিক পরিবর্তন এ ব্যবস্থাতে তুলনামূলক সহজ। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সংবিধান কিংবা সরকার পরিবর্তন করতে হলে এক বিশেষ জটিল পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়।
৬। সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের আইনসভা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। আইনসভা অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে সরকারকে অপসারণ করতে পারে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় আইনসভা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী নয়।
৭। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী প্রথমে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে জয়ের পরে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি কতৃক
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।