দ্বিন ও শরিয়তের মধ্যে পার্থক্য

মহান আল্লাহ পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী আদম (আ.) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। নবীগণ যেমন কিছু অভিন্ন বিষয়ের আহবান জানিয়েছেন, তেমন তাদের শিক্ষায় ছিল কিছু ভিন্নতা। দার্শনিক আলেমরা বলেন, নবী-রাসুলগণ যেসব অভিন্ন বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন তাকে বলা হয় দ্বিন আর তাদের শিক্ষায় যে ভিন্নতা পাওয়া যায় তা হলো শরিয়ত। পৃথিবীর সব নবী ও রাসুল (আ.) অভিন্ন দ্বিন নিয়ে আগমন করেছিলেন।

তবে তাদের শরিয়তে ভিন্নতা ছিল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বিন যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নুহকে, আর যা আমি ওহি করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহিম, মুসা ও ঈসাকে—এই বলে যে তোমরা দ্বিনকে প্রতিষ্ঠিত কোরো এবং তাতে মতভেদ কোরো না।’ (সুরা আশ-শুরা, আয়াত : ১৩)

উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহ অভিন্ন দ্বিন দিয়ে নবীদের পাঠিয়েছেলেন। তবে তাদের শরিয়তে আছে ভিন্নতা। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরিয়ত ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তোমাদের এক জাতি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন তা দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করতে চান।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৪৮)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, “আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছি ‘ইবাদত পদ্ধতি’, যা তারা অনুসরণ করে। ” (সুরা হজ, আয়াত : ৬৭)
অভিন্ন দ্বিনের ব্যাখ্যা হলো, সব নবী ও রাসুল (আ.) মানুষকে এই দাওয়াত দিয়েছেন যে আল্লাহ এক। কেবল তাঁরই ইবাদত করতে হবে। সাহায্য কেবল তাঁরই কাছে চাইতে হবে এবং তিনি সর্বপ্রকার অশোভন থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তাঁর পবিত্র নামগুলোর প্রতি অবিশ্বাস ও অনাস্থা হারাম। বান্দার ওপর আল্লাহর হক এটাই যে বান্দা আল্লাহর এরূপ ইবাদত করবে যাতে ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকে।

আল্লাহর সামনে তারা কায়মনে ঝুঁকে যাবে। তারা আল্লাহর নিদর্শনের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ করবে। তারা পরকাল, কিয়ামত, পুনরুত্থান, জান্নাত-জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস রাখবে। আল্লাহর বান্দারা পার্থিব জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে বিরত থাকবে। তারা ন্যায়ের সহায়ক হবে এবং অন্যায় থেকে বিরত থাকবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে এবং জুলুম প্রতিহত করবে। আল্লাহর দ্বিন প্রচার-প্রসারে সচেষ্ট হবে। এই বিষয়গুলোতে পৃথিবীর সব ধর্মাবলম্বী একমত হওয়ায় কোরআনে তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়নি।

শরিয়ত মূলত আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের পদ্ধতি। এটা বিভিন্ন নবী-রাসুলের যুগে ভিন্ন ভিন্ন ছিল। যেমন মুসা (আ.)-এর শরিয়তে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা হতো, মুহাম্মদ (সা.)-এর শরিয়তে কাবাঘরের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে। মুসা (আ.)-এর শরিয়তে বিবাহিত-অবিবাহিত সব ধরনের ব্যভিচারী-ব্যভিচারিণীর শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড, শরিয়তে মুহাম্মাদিতে অবিবাহিতদের শাস্তি কমিয়ে এক শ দোররা করা হয়েছে ইত্যাদি। শরিয়তের এই ভিন্নতাকে দার্শনিক আলেমরা তুলনা করেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে। কেননা একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে একই রোগের চিকিৎসা বিভিন্নভাবে করে থাকেন। এটা তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞারই নিদর্শন। মহান আল্লাহও বিভিন্ন যুগের বান্দাদের অবস্থা বিবেচনা করে তাদের ইবাদতের পদ্ধতি পাল্টে দিয়েছেন। এ ছাড়া সব ধর্মে আল্লাহ যেসব ইবাদত ও আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন, তা হচ্ছে সেসব কাজ যার ভিত্তি ও উৎস মানুষের অন্তর। তার ভিত্তিতে সেগুলো পরকালে কল্যাণকর বা ক্ষতিকর হয়ে দেখা দেবে। মূলত ইবাদত ও আনুগত্য অন্তরের ব্যাপার। বাহ্যিক কাজগুলো শুধু তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।