বিপ্লবের পরিপূর্ণতা ও স্থায়িত্বের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে যে ঘটনা ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, তা হলো প্রতিবিপ্লব। একটি বিপ্লব যখন সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতাসীন শ্রেণির বিরুদ্ধে রূপ নেয়, তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিলোপ করে একটি নতুন সমাজ বা রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করে, তখন সেই ক্ষমতাচ্যুত শ্রেণি এবং তাদের সমর্থকরা পূর্বাবস্থায় ফিরে আসার জন্য যে আন্দোলন বা প্রচেষ্টা চালায়, সেটিকেই বলা হয় প্রতিবিপ্লব। এই প্রক্রিয়াটি মূলত বিপ্লবের বিরুদ্ধচারী শক্তির পুনরুত্থানের প্রচেষ্টা। বিপ্লব এবং প্রতিবিপ্লব দুটি পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারা। এই দুইয়ের মধ্যে মূল পার্থক্য নিম্নরূপ:
বিপ্লব এবং প্রতিবিপ্লবের মধ্যে পার্থক্যঃ
১. বিপ্লব হল একটি মৌলিক এবং হঠাৎ পরিবর্তন, সাধারণত সামাজিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থায়। এটি একটি ব্যাপক পরিবর্তন যা প্রায়শই সহিংসতার মাধ্যমে ঘটে। অন্যদিকে, প্রতিবিপ্লব হল একটি বিপ্লবের বিরোধিতা এবং বিদ্যমান ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা।
২. বিপ্লব একটি সমাজে বিদ্যমান শোষণমূলক ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা উল্টে দিয়ে, সাধারণ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হয়। এটি সাধারণত গণমানুষের দাবি ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে চায়।
অন্যদিকে, প্রতিবিপ্লবের উদ্দেশ্য বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নতুন কাঠামোকে ধ্বংস করে পুরনো ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ক্ষমতা হারানো এলিট শ্রেণি বা শাসকগোষ্ঠী আবার তাদের পূর্বস্থানে ফিরে আসতে চায় এবং বিপ্লবের অর্জনগুলোকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে।
৩. বিপ্লব সাধারণত একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করে। বিপ্লবের লক্ষ্য হলো স্থায়ী পরিবর্তন।
অন্যদিকে, প্রতিবিপ্লব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়াশীল এবং অস্থায়ী উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করে। এর লক্ষ্য থাকে বিপ্লবের সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করা এবং পুরনো ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এটি মূলত বিপ্লবী চেতনার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকে।
৪. বিপ্লব সাধারণত জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। সাধারণ জনগণ, শ্রমিক, কৃষক এবং মেহনতি মানুষ বিপ্লবের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে, যারা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে শোষিত হয়ে আসছে।
অন্যদিকে, প্রতিবিপ্লব পরিচালিত হয় পুরনো ক্ষমতাসীন শ্রেণি, সামরিক বাহিনী এবং এলিট শ্রেণির মাধ্যমে, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এবং যারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পুরনো ব্যবস্থার দিকে ফিরে যেতে চায়।
৫. বিপ্লব সাধারণত নতুন শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে যা জনগণের অধিকারের ওপর ভিত্তি করে। এটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করে যার মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দেওয়া।
অন্যদিকে, প্রতিবিপ্লব বিপ্লবের পরিবর্তিত কাঠামোকে ভেঙে পুরনো শাসনব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা সাধারণত হয় স্বৈরতান্ত্রিক, শোষণমূলক বা গণতন্ত্রবিরোধী।
৬. উদাহরণ- রাশিয়ার ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব কিংবা ১৯৪৯ সালের চীনের মাওবাদী বিপ্লব উভয়ই সমাজের বুনিয়াদি পরিবর্তন এনেছিল এবং শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিজয় ঘোষণা করেছিল।
অন্যদিকে, রাশিয়ান বিপ্লবের পরপরই সেখানকার রাজতন্ত্রপন্থী এবং বিদেশি শক্তি মিলে যে সশস্ত্র লড়াই চালিয়েছিল, তা ছিল একটি প্রতিবিপ্লবী প্রচেষ্টা। একইভাবে ফরাসি বিপ্লবের পর নেপোলিয়নের সম্রাট হওয়াকে অনেকেই প্রতিবিপ্লব হিসেবে দেখেন।