রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল (Rutherford’s Atom Model):
১৯১১ সালে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে পরমাণুর গঠন সম্পর্কে একটি মতবাদ প্রদান করেন। এ মতবাদ ‘রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল’ নামে পরিচিত।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল:
১। পরমাণুর কেন্দ্রস্থলে ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট একটি ভারী বস্তুকণা বিদ্যমান। এ ভারী বস্তুকণাকে পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস বলে।
২। পরমাণুর মোট আয়তনের তুলনায় নিউক্লিয়াসের আয়তন অত্যন্ত ছোট। এবার একটু সহজে বুঝি, আমাদের দেহের মোট ওজনের তুলনায় দেহের প্রধান শ্বসন অঙ্গ ফুসফুসের ওজন কত? অবশ্যই অত্যন্ত ছোট হবে। তেমনিভাবে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আয়তন পরমাণুর মোট আয়তনের তুলনায় অত্যন্ত ছোট।
৩। পরমাণু সামগ্রিকভাবে চার্জনিরপেক্ষ। অর্থাৎ পরমাণুর সামগ্রিক চার্জশূন্য। আমরা একটি বস্তুকণাকে কখন চার্জনিরপেক্ষ বলতে পারি? যখন ওই বস্তুকণার মধ্যে সমানসংখ্যক ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ বিদ্যমান থাকে। পরমাণুর ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যে কয়টি প্রোটন থাকে, নিউক্লিয়াসের বাইরেও সে কয়টি ইলেকট্রন থাকে। আর প্রোটন হলো ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট এবং ইলেকট্রন হলো ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট। যার ফলে সামগ্রিকভাবে পরমাণুর মোট চার্জ শূন্য হয়।
৪। সূর্যকে কেন্দ্র করে সৌরজগতের গ্রহগুলো যেমন ঘুরতে থাকে, তেমনি ঠিক একইভাবে পরমাণুর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো ঘুরতে থাকে। যেহেতু পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন সৌরজগতের গ্রহগুলোর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, তাই এ মডেলকে সৌরমডেলও বলা হয়।
৫। ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট নিউক্লিয়াস ও ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট ইলেকট্রনের মধ্যে একটি স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণ বল বিদ্যমান। এ আকর্ষণ বল ও ঘূর্ণনের ফলে তৈরি কেন্দ্রবিমুখী বল সমান। ফলে পরমাণুটি স্থিতিশীল হয়। কিভাবে? তোমার প্রশ্ন থাকতে পারে। আমরা জানি, কোনো একটি বস্তুকণা যখন বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে তখন বাইরের দিকে একটি বল কার্যকর হয়, যাকে কেন্দ্রবিমুখী বল বলে। এই বলটির কারণে বস্তুকণা ছিটকে বাইরে চলে যেতে চায়। সুতরাং বস্তুকণাটিকে যদি বৃত্তাকার পথে ঘুরতে হয়, তাহলে বস্তুকণাটির কেন্দ্রের দিকে সমান পরিমাণ বিপরীতমুখী বল ক্রিয়াশীল থাকতে হবে। এ বলটিকে বলা হয় কেন্দ্রমুখী বল। অর্থাৎ বৃত্তাকার পথে ঘূর্ণায়ন বস্তুকণার কেন্দ্রমুখী বল ও কেন্দ্রবিমুখী বল সমান হলে এটি বৃত্তাকার পথে ঘুরতে পারবে। ঠিক তেমনিভাবে পরমাণুর ইলেকট্রন যদি নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার পথে ঘুরতে চায়, তবে এ কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বলের মান সমান হতে হবে। তা না হলে পরমাণুর ইলেকট্রনটি বৃত্তাকার কক্ষপথ থেকে বাইরে ছিটকে যেতে চাইবে। ফলে পরমাণুর অস্তিত্ব বজায় থাকত না।
বোর পরমাণু মডেল (Bohr’s Atom Model):
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের ত্রুটির দিকে লক্ষ রেখে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নিলস বোর কোয়ান্টামতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে একটি মডেল প্রদান করেন। এ মডেলকে বোর পরমাণু মডেল বলা হয়। এ মডেলের তিনটি স্বীকার্য রয়েছে। স্বীকার্যগুলো হলো:
১। শক্তিস্তর সম্পর্কিত ধারণা : পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে কতগুলো অনুমোদিত বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে। এ অনুমোদিত বৃত্তাকার কক্ষপথগুলোকে প্রধান শক্তিস্তর বলে। এ শক্তিস্তরে ইলেকট্রনগুলো ঘূর্ণনের সময় কোনো শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে না। প্রধান শক্তিস্তরকে ‘হ’ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। n=1, 2, 3, 4…
n = 1 হলে, প্রধান শক্তিস্তর = K
n = 2 হলে, প্রধান শক্তিস্তর = L
n = 3 হলে, প্রধান শক্তিস্তর = M
n = 4 হলে, প্রধান শক্তিস্তর = N
২। কৌণিক ভরবেগ সম্পর্কিত ধারণা : একটি নির্দিষ্ট শক্তিস্তর ঘূর্ণমান ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ নির্দিষ্ট এবং তা h/2(pi) এর গুণিতক।
সুতরাং, কৌণিক ভরবেগ, mvr =nh/2(pi)|
এখানে, m = ইলেকট্রনের ভর
v = গতিবেগ
r = শক্তিস্তরের ব্যাসার্ধ
n = প্রধান শক্তিস্তর
h = প্ল্যাংকের ধু্রবক (6.63×10-34 JS)
৩। শক্তির বিকিরণ সম্পর্কিত ধারণা : বোর পরমাণুর মডেল অনুসারে ইলেকট্রন বিভিন্ন শক্তিস্তরে ঘূর্ণমান থাকার সময় কোনো শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে না। কিন্তু ইলেকট্রন এক শক্তিস্তর থেকে অন্য শক্তিস্তরে যাওয়ার সময় শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রন যদি নিম্ন কক্ষপথ থেকে উচ্চ কক্ষপথে স্থানান্তরিত হয় তবে শক্তির শোষণ ঘটবে, আর যদি উচ্চ কক্ষপথ থেকে নিম্ন কক্ষপথে নেমে আসে, তখন শক্তির বিকিরণ ঘটবে।
রাদারফোর্ড ও বাের পরমাণু মডেলের মধ্যে পার্থক্যঃ
১. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের ভিত্তি হলাে রাদারফোর্ড কর্তৃক সম্পাদিত আলফা (৫) কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষার পর্যবেক্ষণ নির্ভর সিদ্ধান্তসমূহ। রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলে পরমাণুর কেন্দ্রে ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস থাকে এবং ধনাত্মক চার্জের সমসংখ্যক ঋণাত্মক ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে সতত আবর্তনশীল থাকে। রাদারফোর্ড মডেলে রয়েছে সৌরজগতের বিন্যাস প্রকরণ।
অন্যদিকে,বাের পরমাণু মডেলের ভিত্তি হলাে রাদারফোর্ড পরমাণু মডেলের পরমাণুর কেন্দ্রস্থ নিউক্লিয়াস ও নিউক্লিয়াস বহির্ভূত ইলেক্ট্রন অঞ্চলের সাথে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ও আইনস্টাইনের আলােক সম্পর্কীয় বিকিরণের কোয়ান্টাম তত্ত্বের সমন্বয়।
২. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে শক্তিস্তরের আকার ও আকৃতি সম্বন্ধে কোন ধারণা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, বোরের পরমাণু মডেলে বৃত্তাকার শক্তিস্তরের ধারণা দেওয়া হয়েছে।
৩. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের সাহায্যে পারমাণবিক বর্ণালী ব্যাখ্যা করা যায় না। অন্যদিকে, বোরের পরমাণু মডেলে বর্ণালী সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
৪. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগের ধারণা দেয় না। অন্যদিকে, বোরের পরমাণু মডেলে ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগের ধারণা দেওয়া হয়েছে।
৫. শক্তির শোষণ বা বিকিরণ সম্বন্ধে কোন ধারনা রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, বোরের পরমাণু মডেলে শক্তির শোষণ ও বিকিরণ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে।