সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে পার্থক্য

সংবেদন ও প্রত্যক্ষণ মনোবিজ্ঞানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যা আমাদের বাস্তবতা অনুধাবনের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে। যদিও সংবেদন ও প্রত্যক্ষণ দুটি শব্দই আমাদের জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের সাথে জড়িত, তাদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে-

সংবেদন (Sensation) :
ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পরিবেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য গ্রহণ করে থাকি। এই তথ্য গ্রহণের সময় আমাদের মধ্যে যে প্রথমিক চেতনার সৃষ্টি হয়, তাকে আমরা বোধ বা অনুভূতি বলে থাকি। এই প্রাথমিক বোধসৃষ্টির প্রক্রিয়াকেই সংবেদন বলে। সংবেদন হল একটি সরল প্রক্রিয়া, যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে বাইরের জগতের যােগাযােগ স্থাপন করে| সংবেদন জ্ঞানেন্দ্রিয় থেকেই উৎপন্ন হয়। প্রকৃতপক্ষে চোখ, কান, নাক, জিভ এবং ত্বক—এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বহির্জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বস্তুর সংস্পর্শ ঘটামাত্র বস্তু সম্পর্ক আমাদের মস্তিষ্কে যে প্রাথমিক চেতনা জাগে তাই হল সংবেদন।

প্রত্যক্ষণ (Perception) :
প্রত্যক্ষণ হল সংবেদন ও প্রতিক্রিয়া এ দু’য়ের মধ্যবর্তী একটি মানসিক অবস্থা। সংবেদনরে যখন ব্যাখ্যা করা হয়, তখনি তা হয়ে উঠে প্ৰত্যক্ষণ। অর্থাৎ সংবেদনের বিশ্লেষণ, সমন্বয়সাধন ও একীভূতকরণের মাধ্যমে বস্তু সম্পর্কে যে অর্থপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা হয়, তাকে প্রত্যক্ষণ বলে।

ক্রাইডার ও অন্যান্যরা বলেছেন, “প্রত্যক্ষণ সংবেদনের একটি ঘনিষ্ট প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে মস্তিষ্ক সংবেদনের নির্বাচন, সংগঠ এবং ব্যাখ্যা করে থাকে।”

মরগান ও কিং বলেছেন, “পৃথিবী আমাদের কাছে কেমন দেখায়, কেমন শুনায়, কেমন অনুভূত হয়, কেমন স্বাদ বা মাং বিশিষ্ট মনে হয় তাকেই প্রত্যক্ষণ বলে। পৃথিবী সম্বন্ধে একজন ব্যক্তির অব্যবহিত অভিজ্ঞতাই হল তার প্রত্যক্ষিত পৃথিবী অর্থাৎ সহজকথায় বলা যায়, আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয় বা বস্তু সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণালব্ধজ্ঞান অর্জন করি। অর্থাৎ, পৃথিবীকে যেভাবে দর্শন করি, শ্রবণ করি, অনুভব করি, ঘ্রাণ নেই এবং স্বাদ গ্রহণ করি সেগুলো হল প্রত্যক্ষণ ”।

সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের মধ্যে পার্থক্যঃ
১। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পরিবেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য গ্রহণ করে থাকি। এই তথ্য গ্রহণের সময় আমাদের মধ্যে যে প্রথমিক চেতনার সৃষ্টি হয়, তাকে আমরা বোধ বা অনুভূতি বলে থাকি। এই প্রাথমিক বোধসৃষ্টির প্রক্রিয়াকেই সংবেদন বলে। অন্যদিকে, সংবেদনের বিশ্লেষণ, সমন্বয়সাধন ও একীভূতকরণের মাধ্যমে বস্তু সম্পর্কে যে অর্থপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা হয়, তাকে প্রত্যক্ষণ বলে।

২। সংবেদন একটি প্রান্তীয় প্রক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষণ একটি কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়া।

৩। সংবেদন হল কেবলমাত্র উপস্থাপনমূলক এবং প্রত্যক্ষণ হল একাধারে উপস্থাপনমূলক ও পুনরুজ্জীবনমূলক প্রক্রিয়া। সংবেদনে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উদ্দীপককে মস্তিষ্কের একটি অংশে উপস্থিত করা হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষণে উদ্দীপকের উপস্থাপন ছাড়াও উদ্দীপকটিকে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে তোলা হয় ।

৪. সংবেদন অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষণ অপেক্ষাকৃত সক্রিয় প্রক্রিয়া। বাইরের জগতের বিভিন্ন ঘটনা ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে এলে সংবেদন সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, সংবেদন একটি নিষ্ক্রিয় প্রক্রিয়া। তার প্রত্যক্ষণের সময় ব্যক্তি বিভিন্ন উদ্দীপনার মধ্যে থেকে মাত্র দুই একটি উদ্দীপকের প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকে। এরূপ মনোযোগ হল প্রত্যক্ষণের একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া।

৫। সংবেদন একটি সরল প্রক্রিয়া। সংবেদনের সময় আমরা কোন বস্তু সম্পর্কে একটি প্রাথমিক অনুভূতি লাভ করে থাকি। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। প্রত্যক্ষণের সময় ঐ বস্তু সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভ করে থাকি ।

৬। সংবেদন একটি অসংগঠিত প্রক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষণ একটি সংগঠিত প্রক্রিয়া।

৭। সংবেদন শিক্ষার্জিত প্রক্রিয়া নয়। সংবেদন দৃষ্টির জন্য শিক্ষণের কোন ভূমিকা নেই। ব্যক্তির ইন্দ্রিয়গুলো ভালো থাকলে সংবেদন ঘটবে। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষণ শিক্ষালব্ধ প্ৰক্ৰিয়া। প্রত্যক্ষণ সম্পূর্ণভাবে শিক্ষণ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

৮। সংবেদন প্রেষণা এবং আশা-আকাঙ্খার প্রভাবমুক্ত। ব্যক্তির ইচ্ছা, অনিচ্ছা, মনোভাব, আবেগ, প্রেষণা ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ শর্তাবলি দ্বারা সংবেদন প্রভাবিত হয় না। অন্যদিকে, ব্যক্তির ইচ্ছা, অনিচ্ছা, মনোভাব, আবেগ, প্রেষণা ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ শর্তাবলি দ্বারা প্রত্যক্ষণ প্রভাবিত হয়।

৯। মনোবিজ্ঞানী Woodworth বলেছেন, সংবেদন হল উদ্দীপকের প্রতি প্রথম প্রতিক্রিয়া। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষণ হল উদ্দীপকের দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া।

১০। সংবেদনে বস্তুর গুণের চেতনা প্রকাশ পায়। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষণে বস্তুর অস্তিত্বের চেতনা প্রকাশ পায়।

১১। কোনো ফুল স্পর্শ করে তার মসৃণতা অনুভব করা, কোনো খাবার খেয়ে তার স্বাদ অনুভব করা, কোনো শব্দ শুনে তার উচ্চতা অনুভব করা ইত্যাদি। এটিই সংবেদন। অন্যদিকে, উদাহরণ: আমরা যখন কোনো ফুল দেখি, তখন আমরা শুধু তার রং, আকারই দেখি না, বরং আমরা এটি একটি ফুল বলে চিনতে পারি, এর সৌন্দর্য অনুভব করতে পারি। এটিই প্রত্যক্ষণ।