প্রমিত ভাষা (Standard Language):
বাংলা ভাষার গবেষক ও চর্চাকারীদের মধ্যে একটি প্রশ্ন প্রায়ই উত্থাপিত হয়- বাংলা প্রমিত উচ্চারণ কেন প্রয়োজন? উত্তরে বলব, প্রধানত একটি সুশৃঙ্খল (আমার মতে সুন্দরও) ভাষারীতি মেনে চলা, বাংলা ভাষার উত্তরোত্তর উন্নয়নে বিশ্ব দরবারে এ ভাষার একটি পরিপাটি রূপের পরিচয় তুলে ধরার প্রয়োজনে; যাতে করে বিদেশে আমাদের বাংলা ভাষার বদলে কোনো আঞ্চলিক বাংলা যেমন- ‘সিলেইট্ট্যা বাংলা’ বা ‘চাঁটগাঁইয়া বাংলা’ ইত্যাদি না বলতে হয় (শুনেছি, লন্ডনে বসবাসরত বাঙালিদের অনেকেই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারেন না, বলেন ‘সিলেইট্ট্যা বাংলা’য় যার মর্মার্থ বাংলাদেশের বেশিরভাগ জেলার মানুষই উদ্ধার করতে পারবেন না)।
ভাষা যেহেতু ভাব বিনিময় ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম, তাই দেশের মধ্যেই অন্তত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ফোরামগুলোতে একে অপরের সার্থক যোগাযোগের প্রয়োজনেও আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবমুক্ত একটি ভাষারীতি থাকা দরকার। আঞ্চলিক ভাষার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমের জন্য প্রমিত ভাষা ব্যবহার করা হয়। প্রমিত ভাষা হচ্ছে ভাষার আদর্শ রূপ। এ ভাষায় কথা বললে সব অঞ্চলের মানুষ সহজে বুঝতে পারবে। যেমন- ‘অমিত যেখানে সেখানে হো হো করে বেড়াচ্ছে ,ফিরপোর দোকানে যাকে তাকে চা খাওয়াচ্ছে, যখন তখন মোটরে চড়িয়ে বন্ধুদের অনাবশ্যক ঘুরিয়ে নিয়ে আসছে।’
উপভাষা (Dialect):
ভাষা হল মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বিভিন্ন স্থানে মানুষের ভাষা বিভিন্ন হয়। যেমন পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা, আবার পাশের রাজ্য বিহারের ভাষা হিন্দি। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার ভাষা ও হুগলি জেলার ভাষা শুনলে বোঝা যাবে এই দুটিই বাংলা ভাষা হলেও, দুই অঞ্চলের ভাষায় অনেক পার্থক্য আছে। আসলে কোনো ভাষা যখন বৃহৎ অঞ্চলে প্রচলিত থাকে, তখন বিভিন্ন অঞ্চলে একই ভাষার ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রচলিত থাকে। এই রূপগুলি উপভাষা নামে পরিচিত। উপভাষা কাকে বলে, এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলতে পারি: বৃহৎ অঞ্চলে প্রচলিত কোনো ভাষা অঞ্চলভেদে যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে, ভাষার সেই আঞ্চলিক রূপভেদগুলিকে উপভাষা বলে।
অর্থাৎ বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চলে মুখের ভাষার যেভিন্ন ভিন্ন রুপ দেখা যায়, তাকে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে। যেমন- কোনো এক ব্যক্তির দুই পুত্র ছিল। যেমন-
নোয়াখালীঃ একজন মাইনসের দুগা হোলা আছিল।
ময়মনসিংহঃ এক জনের দুই পুৎ আছিল।
প্রমিত ভাষা ও উপভাষার মধ্যে পার্থক্যঃ
প্রমিত ভাষা ও উপভাষা দুটিই মানুষের মুখের ভাষা হলেও এদের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। প্রমিত ভাষা ও উপভাষার মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-
১. প্রমিত ভাষা হচ্ছে ভাষার আদর্শ রূপ। অন্যদিকে, উপভাষা হচ্ছে ভাষার আঞ্চলিক রূপ।
২. প্রমিত ভাষা একটি ভাষাভাষী অঞ্চলে সর্বজন-ব্যবহার্য। অন্যদিকে, উপভাষা কোনও ভাষাভাষী অঞ্চলের মধ্যে ক্ষুদ্রতর একটি অঞ্চলেই ব্যবহারের যোগ্য।
৩. প্রমিত ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, উপভাষা শিক্ষার মাধ্যম রূপে ব্যবহৃত হয় না।
৪. প্রমিত ভাষায় অধিকাংশ সাহিত্য রচিত হয়। অন্যদিকে, আঞ্চলিক সাহিত্যে উপভাষা স্থান পেলেও শুধুমাত্র উপভাষাতেই রচিত সাহিত্যের সংখ্যা নগণ্য।
৫. সরকারি কাজ-কর্ম প্রমিত ভাষায় নির্বাহিত হয়। অন্যদিকে, সরকারি কাজ-কর্ম উপভাষায় নির্বাহিত হয় না।
৬. প্রমিত ভাষায় কথ্য ও লেখ্য উভয় রূপই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, উপভাষায় লেখ্য রূপটিই গুরুত্বপূর্ণ।
৭. ভাষাবিদ, সাহিত্যক ও শিক্ষিত সমাজের মাধ্যমে পরিমার্জিত হয়ে ভাষা যে রূপটি সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয় সেটিই প্রমিত ভাষা। অন্যদিকে, উপভাষা মৌখিক ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়। এর রূপায়ণে কারো পরিকল্পিত প্রচেষ্টা দেখা যায় না।
৮. প্রমিত ভাষায় সংশ্লিষ্ট কেবল শিষ্ট রূপটি গৃহীত হয়। অন্যদিকে, শিষ্ট ও অশিষ্ট দুটোই রূপই ব্যবহৃত হয়।