ট্র্যাজেডি (Tragedy) :
বাংলায় সাধারণভাবে ট্র্যাজেডি নাটককে আমরা বলে থাকি বিয়োগান্তক নাটক, কারণ প্রায়ই এই জাতীয় নাটকের শেষে একটি বিয়োগ বা মৃত্যুর ঘটনা থাকে। কিন্তু ট্র্যাজেডির পক্ষে মৃত্যু অপরিহার্য নয়, এবং মৃত্যু থাকলেই তা ট্র্যাজেডি হয় না। বাংলায় এই জাতীয় নাটককে বরং বিষাদান্ত নাটক বলা যেতে পারে।
ইংরেজি ‘Tragedy’ শব্দটি গ্রীক ‘Tragoedia’ শব্দ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। যার বুৎপত্তিগত অর্থ ‘goat song’ বা ছাগগীতি। প্রাচীন গ্রীক দেবী ডায়োনিশাসের উৎসব উপলক্ষে ছাগলের মুখোশ পরে একধরনের করুন রসাত্মক গান পরিবেশিত হতো। সেই থেকে ট্র্যাজেডি সম্পর্কিত ধারণাটি গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। প্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাঁর ‘The poetics’ গ্রন্থে ট্র্যাজেডি সম্পর্কে সুবিস্তৃত ধারণা ব্যক্ত করেছেন। অ্যারিস্টটলের ভাবনার সূত্র ধরে ভাষাচার্য ড. শিশির কুমার দাস ট্র্যাজেডি সম্পর্কে বলেছেন-
“ট্র্যাজেডি হলো একটি গুরুগম্ভীর স্বায়ংসম্পূর্ণ বিশেষ আয়তন বিশিষ্ট ঘটনাবৃত্তের অনুকরণ; ভাষার সৌন্দর্য্যে যার প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র এবং যার প্রকাশরীতি বর্ণনাত্মক নয়, নাটকীয়; আর যে ঘটনা দর্শক পাঠকচিত্তে করুনা ও ভয়ের মধ্য দিয়ে চিত্তশুদ্ধি ঘটায় তাই হলো ট্র্যাজেডি।”
মহাকাব্য (Epic) :
ইংরেজি ‘Epic’ এর বাংলা প্রতিশব্দ মহাকাব্য। ‘Epic’ শব্দটি এসেছে গ্রীক ‘Epices’ বা ‘Epos’ থেকে। ‘Epic’ হচ্ছে দীর্ঘ বীরগাথা। এখানে বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী থাকে, যে ভাষাতেই লেখা হোক, তা বিষয় ও ভাষায় মহত্বের ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। পাশ্চাত্য আদর্শে অনুসরণের মাধ্যমে আমরা মহাকাব্যের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলতে পারি যে, নানা সর্গে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত যে-কাব্যে কোন সুমহান বিষয়-বস্তুকে অবলম্বন করে এক বা বহু বীরোচিত চরিত্র অথবা অতিলৌকিক-শক্তি-সম্পাদিত কোন নিয়তি-নির্ধারিত-ঘটনা ওজস্বী ছন্দে বর্ণিত হয়, তাকে মহাকাব্য বলে।
গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল মহাকাব্য কি সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন তাঁর “Poctics” নামক গ্রন্থে তেইশ ও চব্বিশ আধ্যায়ে। সেখানে তিনি বলেছেন-
“They should be based on a single action, one that is complete whole in itself, with a beginning, a middle, and an end so as to enable the work to produce its own proper pleaser with all the organic unity of a living creature ….. As for its metre, the heroic has been assigned to it from experience.”
ট্র্যাজেডি ও মহাকাব্যের মধ্যে পার্থক্যঃ
আমরা ট্র্যাজেডি ও মহাকাব্যকে এক সাথে গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু ট্র্যাজেডি ও মহাকাব্যের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগতভাবে তাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ট্র্যাজেডি ও মহাকাব্যের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-
১. একটি মহাকাব্য একটি দীর্ঘ কবিতা যা ঐতিহাসিক বা কিংবদন্তী বা ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ এক মহাকাব্যিক বীরের কর্ম ও সাহসিকতার বিবরণ দেয়। অন্যদিকে, একটি ট্র্যাজেডি হ’ল একটি কবিতা বা নাটক যা ট্র্যাজিক ঘটনা নিয়ে গঠিত এবং একটি অসুখী শেষ হওয়া, বিশেষত একটি মূল চরিত্রের পতন সম্পর্কিত।
২. ট্র্যাজেডির আয়তন হয় নির্দিষ্ট এবং সুসংবদ্ধ। কাহিনির আরম্ভ ও শেষ যেন একইসঙ্গে গোচরীভূত হয়। অন্যদিকে, মহাকাব্যে কাহিনী সে তুলনায় অনেক দীর্ঘ হতে পারে। তার কারণ নাটকে সমকালে সংঘটিত অনেক ঘটনা একই সঙ্গে দেখানো সম্ভব নয়। কারণ রঙ্গমঞ্চে এককালে একটি ঘটনার অভিনয়ই সম্ভব। কিন্তু মহাকাব্য যেহেতু বর্ণনাত্মক সেজন্য একই সময়ে ঘটছে এমন অনেক ঘটনা সেখানে বর্ণিত হতে পার, তার ফলে কাহিনীর আয়তনে আসে বিস্তৃতি ।
৩. মহাকাব্যের ছন্দ হবে ‘শূরছন্দ’ বা ‘ষটপদী’। ইংরেজিতে একে হিরোয়িক কাপলেট বলা হয়। অ্যারিস্টটল বলেছেন – “যদি অন্য কোন এক বা একাধিক ছন্দে কেউ মহাকাব্য রচনা করতে চান তার ফল তৃপ্তিকর হবে না। শূরছন্দই সবচেয়ে গম্ভীর, সবচেয়ে রাজকীয়,এর মধ্যেই অপরিচিত শব্দ ও রূপক ব্যবহারের স্বাচ্ছন্দ্য সবচেয়ে বেশি-আর এই ব্যপারে বর্ণনাত্মক কাব্য অন্য সব কাব্যের চেয়ে বেশি ব্যাপক।”
অন্যদিকে, ট্র্যাজেডিতে একাধিক ছন্দ ব্যবহার করা হয়, কারণ সেখানে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির সংলাপ।
৪. আয়তন বলতে অ্যারিস্টটল দুটি জিনিস বুঝিয়েছেন -বিশালতা দু– দিক থেকেই মহাকাব্য অনেক বড়ো। অন্যদিকে, আয়তনের দিক থেকে ট্র্যাজেডি ছোট এবং মহাকাব্য বড়ো।
৫. মহাকাব্যের উপাদান চারটি। অন্যদিকে, ট্র্যাজেডির উপাদান ছয়টি।
৬. ট্র্যাজেডি এবং মহাকাব্য উভয়ই ঘটনার অনুকরণ করে। তবে উভয়ের অনুকরণের ভিন্নতা আছে। ট্র্যাজেডি অনুকরণ পদ্ধতি নাটকীয়। অন্যদিকে, মহাকাব্যের অনুকরণ পদ্ধতি বর্ণনাত্মক।
৭. মহাকাব্য অভিজাত রুচির পাঠকেরা আস্বাদ করে থাকেন। অন্যদিকে, ট্র্যাজেডি অনেক সময় নিম্নরুচির দর্শকও আস্বাদন করে থাকেন।
৮. ট্র্যাজেডিতে মহাকাব্যের সব উপাদান আছে, কিন্তু মহাকাব্যে ট্র্যাজেডির সব উপাদান নেই।