Site icon Parthokko.com.bd | পার্থক্য | Difference Between

বৈদিক ভাষা ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যে পার্থক্য

বৈদিক ভাষা ও সংস্কৃত ভাষা

বৈদিক ভাষা (Vedic Language):
বেদের ভাষাকে বৈদিক ভাষা বলা হয়। বৈদিক ভাষা মূলত একটি পরিকল্পিত ভাষা। এর মধ্যে একটি ক্রমিক বিবর্তন লক্ষ করা যায়। ক্রমিক বিবর্তনটি হলো ভাষার একটি প্রাচীন (পুরাতন) রূপ অপরটি অর্বাচীন (নবীন) রূপ। আমরা জানি বৈদিক যুগের প্রাচীনতম রচনা ঋগ্বেদসংহিতার। এই সংহিতার দশম মন্ডলেটিকে অনেকে অর্বাচীন (নবীন) বলেন। সুতরাং সেটিকে বাদ দিয়ে ঋগ্বেদসংহিতার অন্যান্য মন্ডলে আমরা বৈদিক ভাষার প্রাচীন (পুরাতন) স্তরের পরিচয় পাই। এছাড়া সাম, যজুঃ, অথর্ব সংহিতায় প্রাচীন ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে এবং আরণ্যক ও উপনিষদ গ্রন্থের প্রাচীন অংশে অর্বাচীন (নবীন) বৈদিক ভাষার লক্ষণ দেখা যায়। বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্গত আরও পরবর্তীকালীন সূত্র বা বেদাঙ্গ জাতীয় রচনাগুলিতেও প্রাচীন রচনাশৈলীর ছাঁদ বদলের ক্ষণটি লক্ষ করা যায়।

উক্ত সমগ্র বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে আমরা যে বৈদিক ভাষার পরিচয় পাই তার প্রধান ক্সবশিষ্ট্য হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা এবং ব্যবহারে বৈচিত্র। মনে করা হয় কোনো ভাষানিয়ন্ত্রকের অভাবে বৈদিক ভাষা ছিল বিক্ষিপ্ত, কেন্দ্রাতিগ, স্বচ্ছন্দচারী একটি ভাষা স্রোত। এই ভাষায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত একাধিক বিকল্পরূপের ব্যবহার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন- বৈদিক শব্দরূপের ক্ষেত্রে অ-কারান্ত ‘নর’ শব্দের প্রথমার দ্বিবচন, বহুবচন; দ্বিতীয়ার দ্বিবচন; তৃতীয়ার একবচন, বহুবচন; ষষ্ঠীর বহুবচন; সম্বোধনের বহুবচনে একাধিক রূপ (নরৌ․/ নরা, নরাঃ/নরাসঃ; নরৌ․/ নরা; নরেণ/ নরা, নরৈঃ/নরেভিঃ; নরাণাম্ / নরাম্; নরাঃ / নরাসঃ) দেখা যায়। তদ্রূপ বৈদিক ধাতুরূপের ক্ষেত্রেও একই ধাতুর ভিন্ন ভিন্ন রূপ হতে দেখা যায়। যেমন, কৃ-ধাতু-কৃণোতি, করোতি, কর্ষি; ভূ-ধাতু-ভবতি, বিভর্ত্তি ইত্যাদি। এরূপ বিকল্পরূপ বৈদিক ভাষার ব্যাকরণের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়।

সংস্কৃত ভাষা (Sanskrit Language):
সংস্কৃত ভাষার সঠিক নাম: संस्कृता वाक्, সংস্কৃতা বাক্, পরবর্তীকালে প্রচলিত অপর নাম: संस्कृतभाषा সংস্কৃতভাষা, “পরিমার্জিত ভাষা”) হল একটি ঐতিহাসিক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা এবং হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের পবিত্র দেবভাষা। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান দুই বিভাগের একটি “শতম” ভুক্ত ভাষা। বর্তমানে সংস্কৃত ভারতের ২২টি সরকারি ভাষার অন্যতম এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা।

ধ্রুপদী-সংস্কৃত এই ভাষার প্রামাণ্য ভাষা প্রকার। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত পাণিনির ব্যাকরণে এই প্রামাণ্যরূপটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপে লাতিন বা প্রাচীন গ্রিক ভাষার যে স্থান, বৃহত্তর ভারতের সংস্কৃতিতে সংস্কৃত ভাষার সেই স্থান। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,“ বহুধাবিভক্ত ভারত ছোটো ছোটো রাজ্যে কেবলই কাড়াকাড়ি হানাহানি করেছে, সাধারণ শত্রু যখন দ্বারে এসেছে সকলে এক হয়ে বিদেশীর আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি। এই শোচনীয় আত্মবিচ্ছেদ ও বহির্বিপ্লবের সময়ে ভারতবর্ষে একটিমাত্র ঐক্যের মহাকর্ষশক্তি ছিল, সে তার সংস্কৃত ভাষা।

বৈদিক ভাষা ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যে পার্থক্যঃ

বৈদিক ও সংস্কৃত বেশ কাছাকাছি, তবে বেশ কিছু ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে বৈদিক ভাষা ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে-

১. বৈদিকে, বিশেষতঃ ঋগবেদের স্বর (Pitch accent) ছিল অপরিহার্য; স্বরের পরিবর্তনও ঘটতে পারতাে এবং তাতে অনেক সময় অর্থেরও পরিবর্তন ঘটতাে। অন্যদিকে, সংস্কৃতে স্বরের কোন স্থান নেই।

২. বৈদিক ভাষার অনেক ধ্বনি আর সংস্কৃতে পাওয়া যায় না। যেমন ৯, কেবল ব্যতিক্রম ক৯প্‌।

৩. বৈদিক ভাষায় মূর্ধন্য ধ্বনির ব্যবহার বেশ কম ছিল। অন্যদিকে, ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে তার ব্যবহার খুবই বেশি।

৪. বৈদিক ভাষায় স্বরাঘাতের প্রভাব ছিল অনেক বেশি এবং স্বরাঘাতের স্থান বদলের সাথে সাথে অর্থও বদলে যেত। অন্যদিকে, ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে এই বৈশিষ্ট্য নেই।

৫. বৈদিকে সন্ধি অপরিহার্য ছিল না। যেমন – মনীষা অগ্নি এই প্রয়োগ ছিল। অন্যদিকে, ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে সন্ধি প্রায় বাধ্যতামূলক। মনীষাগ্নি ছাড়া অন্য প্রয়োগ দেখা যাবে না।

৬. শব্দরূপ বৈদিকে অনেক বেশি ছিল। অন্যদিকে, ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে তা অনেক কমে এসেছে।

৭. বৈদিক ভাষায় সমাসের জটিল রূপ তেমন ছিল না। তিনটির বেশি পদের সমাস তেমন দেখা যেত না। অন্যদিকে, ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে বহু পদ মিলে সমাসের এক অত্যন্ত জটিল রূপ প্রায়শই দেখা যায়, যার উদাহরণ পাওয়া যাবে বাণভট্টের কাদম্বরীতে।

৮. বৈদিকে মোট আটটি কারক ছিল, সম্বন্ধ পদ ও সম্বোধন পদ সমেত। অন্যদিকে, ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে ক্রিয়ান্বয়ী কারকম এই সূত্র মেনে এই দুটিকে কারক বলে ধরা হয় নি।

৯. বৈদিকে প্রাক আর্য ভাষার শব্দ ও ধাতু তেমন দেখা যায় না। অন্যদিকে, ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতে বিভিন্ন প্রাক আর্য ভাষার ধাতু ও শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

Exit mobile version