মজুরী (Wages) :
শ্রম শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবীয় উপাদান আর মানবীয় উপাদান বলে শ্রম অন্য যে কোন উপাদান অপেক্ষা গুরুত্বের দাবি রাখে। শ্রমিক শ্রমবাজারে শ্রম সরবরাহ করে কিছু প্রাপ্তির আশায়। আর এ প্রাপ্তিই হচ্ছে মজুরি। শ্রমিকদেরকে শ্রমের বিনিময়ে মালিক পক্ষ যে পারিশ্রমিক প্রদান করে তাকে মজুরী বলে। কিন্তুু সকল প্রকার পারিশ্রমিককে মজুরী বলা হয় না। শুধুমাত্র উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত শ্রমিকদেরকে কায়িক শ্রমের জন্য প্রদত্ত পারিশ্রমিককে মজুরী বলা হয়।
অধ্যাপক বেনহাম বলেন, ‘‘চুক্তি অনুযায়ী নিয়োগকারী শ্রমিকদের তাদের কার্যের বিনিময়ে যে অর্থ প্রদান করে তাকে মজুরী বলে।’’
ডেল ইউডোর বলেন, ‘‘কর্মচারীরা নিয়োগকারীর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করে থাকে এবং বিনিময়ে যে পারিশ্রমিক পায় তাকে মজুরী বলে।’’
কে. কে. ডোয়েট বলেন, ‘‘শ্রমিকের সেবার বিনিময়ে যা প্রদান করা হয় তাকেই মজুরী বলা হয়। ’’
এডউইন বি. ফ্লিপ্পো বলেন, ‘‘মজুরী বা পারিশ্রমিক বলতে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তে শ্রমিকদের প্রচেষ্টা এবং অবদানের দরুণ তাদেরকে যথেষ্ট এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে পুরস্কৃতকরণকে বুঝায়।’’
J.E. Brown এবং H.A. Wolf-এর মতে “Wages are the payments made for the use of labour in production.”
বেতন (Salary) :
সহজ ভাষায় যে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কর্মকান্ডে সরাসরি জড়িত থাকে না এবং যাদের কার্যক্রম সরাসরি পরিমাপও করা যায় না তাদের শ্রমের বিনিময়ে তাদেরকে যে মূল্য বা পারিশ্রমিক বা পুরস্কার প্রদান করা হয় তাকে বেতন বলে। এ প্রসঙ্গে Dale Yoder বলেন, ‘‘অফিস সহকারী, তত্ত্বাবধায়ক ও ব্যবস্থাপনা কর্মচারীদেরকে মাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে যে অর্থ প্রদান করা হয় তাকে বেতন বলে।’’ অফিস সহকারী, হিসাবরক্ষক, ব্যবস্থাপক, তত্ত্বাবধায়ক তাদের মানসিক শ্রমের বিনিময়ে যে মূল্য প্রদান করা হয় তা বেতন নামে পরিচিত এবং তাদের বেতন ব্যাংক হিসাবে অথবা চেকে প্রদান করা হয়।
তাদেরকে নির্বাচনের নিয়ম-কানুন মেনে স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয়। সুতরাং বলা যায়, যে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রতিষ্ঠান নিয়োগের আনুষ্ঠানিক নিয়ম-কানুন মেনে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দান করে এবং মাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে যাদের কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক প্রদান করা হয় তাকে বেতন বলা হয়।
মজুরী ও বেতনের মধ্যে পার্থক্যঃ
বাংলাদেশে, মজুরি ও বেতন উভয়ই শ্রম আইনের আওতায়। মজুরি ও বেতন উভয়ই কর্মচারীকে প্রদত্ত অর্থ। তবে, এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। তা নিম্নরূপ-
১। জুরি হল প্রতিদিন পরিশ্রমের জন্য যে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় তাকেই মজুরি বলা হয়। মজুরি সাধারণত ঘণ্টায় বা দৈনিক হারে নির্ধারিত হয়। মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কর্মচারীর দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, কাজের পরিমাণ, কাজের গুণমান ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হয়।
অন্যদিকে, বেতন হল কর্মচারীর কর্ম সম্পাদনের বিনিময়ে প্রদত্ত টাকা। বেতন সাধারণত মাসিক হারে নির্ধারিত হয়। বেতন নির্ধারণের ক্ষেত্রে কর্মচারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, কর্মক্ষেত্রে পদবী, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হয়।
২। মজুরী উৎপাদন কর্মকান্ডের সহিত প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। অন্যদিকে, বেতন উৎপাদন কর্মকান্ডের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়।
৩। শিল্প শ্রমিক বা কৃষি কর্মীদের ক্ষেত্রে মজুরী প্রদান করা হয়। অন্যদিকে, শিল্প ক্ষেত্রে বা অফিস আদালতে করণিক বা উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত কর্মীদের বেতন প্রদান করা হয়।
৪। মজুরী প্রাপ্ত কর্মীরা সাধারণত অশিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, বেতন প্রাপ্ত কর্মীরা সাধারণত শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।
৫। মজুরী ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ বা পাক্ষিক ভিত্তিতে প্রদান করা হয়। অন্যদিকে, বেতন মাসিক বা বাৎসরিক ভিত্তিতে প্রদান করা হয়।
৬। মজুরী সময় ভিত্তিক, উৎপাদন ভিত্তিক ও প্রণোদনামূলক হতে পারে। অন্যদিকে, বেতন নির্দিষ্ট সময়ান্তে যেমন-মাসিক, বাৎসরিক ভিত্তিতে হয়ে থাকে।
৭। শ্রমিকরা অতিরিক্ত সময় কাজ করলে অতিরিক্ত মজুরী পায়। অন্যদিকে, বেতনভুক্ত কর্মচারীরা অতিরিক্ত কাজের জন্য অতিরিক্ত বেতন পায় না।
৮। মজুরী সাধারণত নগদে পরিশোধ করা হয়। অন্যদিকে, বেতন কর্মীর ব্যাংক হিসাবে অথবা চেকে প্রদান করা হয়।
৯। উৎপাদনের পরিমাণের ভিত্তিতেও মজুরী পরিশোধ করা সম্ভব। অন্যদিকে, উৎপাদিত পণ্যের সংখ্যা বা পরিমাণের ভিত্তিতে বেতন পরিশোধ করা সম্ভব নয়।