লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য

লিখিত সংবিধানঃ

লিখিত সংবিধানের বেশির ভাগ ধারা লিখিত থাকে বলে এটি জনগণের কাছে সুস্পষ্ট ও বোধমগ্য হয়। লিখিত সংবিধানে সাধারণত সংশোধন পদ্ধতি উল্লেখ থাকে বিধায় খুব সহজে পরিবর্তন বা সংশোধন করা যায় না। কিন্তু সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। লিখিত সংবিধান পরিবর্তিত সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। এ জন্য এটি কখনো কখনো প্রগতির অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। তা ছাড়া অনেক সময় সংবিধান সংশোধনের জন্য জনগণ বিপ্লব করতে বাধ্য হয়। লিখিত সংবিধান স্থিতিশীল বিধায় শাসক তাঁর ইচ্ছামতো এটি পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারেন না।

তাই লিখিত সংবিধান যেকোনো পরিস্থিতিতে স্থিতিশীল থাকতে পারে। লিখিত সংবিধানের সব ধারা জনগণ ও শাসক মেনে চলতে বাধ্য হয়। লিখিত সংবিধানের বেশির ভাগ বিষয় দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে। যেমন—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লিখিত।

অলিখিত সংবিধানঃ

সমাজ সর্বদা প্রগতির দিকে ধাবিত হয়। আর অলিখিত সংবিধান সমাজের প্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সহজে পরিবর্তন করা যায়। অর্থাৎ এটি সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে। তাই অলিখিত সংবিধান প্রগতির সহায়ক। কিন্তু অধিক পরিবর্তনশীলতা আবার অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির করতে পারে। অলিখিত সংবিধান যেহেতু সহজে পরিবর্তনীয়, তাই জরুরি প্রয়োজন মেটাতে অলিখিত সংবিধান অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অলিখিত সংবিধান ঘন ঘন পরিবর্তনের ফলে কোনো স্থায়ী নীতি ও কার্যক্রম হাতে নেওয়া যায় না। এর ফলে সরকারব্যবস্থা অস্থিতিশীল হতে পারে।

অলিখিত সংবিধানের বেশির ভাগ নিয়ম কোনো দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে না। এ ধরনের সংবিধান প্রথা ও রীতি-নীতিভিত্তিক, চিরাচরিত নিয়ম ও আচার-অনুষ্ঠানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। যেমন—ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত।

লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্যঃ

লিখিত সংবিধানের বেশির ভাগ ধারা লিখিত থাকে বলে এটি জনগণের কাছে সুস্পষ্ট ও বোধমগ্য হয়। লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-

১। লিখিত সংবিধান একটি সংবিধান পরিষদ বা কনভেনশন কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত এবং প্রযুক্ত হয়। অন্যদিকে, অলিখিত সংবিধান গুলি প্রথা,আচার-ব্যবহার,রীতিনীতি এবং বিচারালয়ের রায় প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।

২। লিখিত সংবিধানে সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। কোনো সরকার, প্রতিষ্ঠান বা কোনো ব্যক্তিই কখনো সাংবিধানিক আইনের বিরোধিতা অথবা সাংবিধানিক আইন ভঙ্গ হতে পারে না। যদি কেউ সাংবিধানিক আইন ভঙ্গ করে থাকে তাহলে তাকে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে। অন্যদিকে, অলিখিত সংবিধানের সাংবিধানিক আইনের কোনো অস্তিত্ব থাকে না বলে সেখানে আইনসভা প্রণীত আইনই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে।

৩। লিখিত সংবিধানের রচনাকাল সর্বদা নির্দিষ্ট থাকে বা তার রচনাকাল নির্দিষ্টরূপে উল্লেখ করা থাকে। প্রতি আইন নির্দিষ্ট তারিখ সহ উল্লেখ করা থাকে। অন্যদিকে, অলিখিত সংবিধানের ক্ষেত্রে আইনগুলি দীর্ঘদিনের বিবর্তনের ফলে গড়ে ওঠে। তাই এগুলির রচনাকাল নির্দিষ্ট নয়।

৪। লিখিত সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ও কার্যাবলী বন্টন করে দেওয়া থাকে। কিন্তু অলিখিত সংবিধান হল প্রথা ও রীতিনীতি নির্ভর। অন্যদিকে, অলিখিত সংবিধানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সুনির্দিষ্টভাবে বন্টিত থাকে না।

৫। লিখিত সংবিধান সরকার সহজে পরিবর্তন করতে পারেন না। ফলে লিখিত সংবিধান নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার প্রশ্নে অধিক কার্যকরী। অন্যদিকে, সংবিধান অলিখিত হলে সরকার খুব সহজেই নাগরিক অধিকার সংকুচিত করে নিজেদের স্বার্থ সুনিশ্চিত করে।

৬। লিখিত সংবিধান সাধারণত দুষ্পরিবর্তনীয়। তাই লিখিত সংবিধান আপাতদৃষ্টিতে গতিশীল নয়। অন্যদিকে, অলিখিত সংবিধানের ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল সমাজ , অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা ; জনগণের আশা – আকাঙ্খা – ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে সহজেই পরিবর্তন করা হয়। তাই অলিখিত সংবিধান গতিশীল।

৭। লিখিত সাংবিধানিক ব্যবস্থায় সংবিধানকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা থাকে বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগকে সংবিধানের রক্ষাকর্তা বলা হয়। অন্যদিকে, অলিখিত সংবিধানে সরকার ও আইনসভার হাতে আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তনের সকল ক্ষমতা নিহিত থাকে। ফলে অলিখিত সাংবিধানিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের প্রাধান্য থাকেনা।

৮। লিখিত সংবিধানে প্রথা , রীতিনীতি ইত্যাদির তুলনায় গণপরিষদ বা আইনসভা কর্তৃক গৃহীত আইনগুলিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অন্যদিকে, অলিখিত সাংবিধানিক ব্যবস্থায় প্রথা , রীতিনীতি – ইত্যাদিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়।